আলোচিত রায়:
মানবতাবিরোধী মামলায় আপিল বিভাগে খালাস পেলেন জামায়াত নেতা আজহার
প্রকাশিত: মে ২৭, ২০২৫, ১১:৪০ দুপুর

ছবি: সংগৃহিত
বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন নজির সৃষ্টি করলো সর্বোচ্চ আদালতের একটি রায়। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে খালাস দিয়েছেন আপিল বিভাগ। এ রায়ের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নির্দোষ সাব্যস্ত হলেন এবং মুক্তি পেলেন।
২৭ মে মঙ্গলবার সকাল ৯টা ৫২ মিনিটে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চ একমত হয়ে এই রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন—বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি ইমদাদুল হক, বিচারপতি মো. আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব। সাত বিচারপতির সর্বসম্মত রায়ে জানানো হয়—আজহারুল ইসলাম নির্দোষ, এবং তাকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে।
২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এটিএম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দেন। অভিযোগ ছিল, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর অঞ্চলে তিনি গণহত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, আটক, নির্যাতন, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগসহ ছয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ছিলেন। অভিযোগপত্রে বলা হয়, এই সব অপরাধে প্রায় ১,২৫৬ জন মানুষ প্রাণ হারান।
২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি আইনজীবীরা ১১৩টি যুক্তি দেখিয়ে আজহারুল ইসলামকে নির্দোষ দাবি করে আপিল করেন। ৯০ পৃষ্ঠার মূল আপিল ও ২৩৪০ পৃষ্ঠার সম্পূরক নথি জমা দেওয়া হয়।
২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর, সেই আপিল খারিজ করে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ। এরপর রিভিউ আবেদন করেন আজহার। এই আবেদনেই অবশেষে পরিবর্তন আসে দৃশ্যপটে। দীর্ঘ শুনানি শেষে ৮ মে আপিল বিভাগের শুনানি শেষ হয় এবং ২৭ মে রায়ের দিন ধার্য করা হয়।
আজহারের পক্ষে আদালতে ছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির, ব্যারিস্টার এহসান আবদুল্লাহ সিদ্দিক, ব্যারিস্টার ইমরান আবদুল্লাহ সিদ্দিক, ও ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন। রায় ঘোষণার পর শিশির মনির বলেন, আমরা আইনের নিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করেছিলাম। এই রায় তারই প্রতিফলন। দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে আজহারুল ইসলাম ন্যায়বিচার পেলেন।
রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনীক আর হক এবং প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। রায়ের পর রাষ্ট্রপক্ষ কোনো মন্তব্য না করলেও, আইনজ্ঞ মহলে রায়ের নানা বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে।
রায় ঘোষণার পরপরই সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে উপস্থিত ছিলেন জামায়াতের শীর্ষ নেতারা। উপস্থিত ছিলেন দলের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাসুম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়েরসহ অনেকেই। তারা রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এই রায়ে প্রমাণিত হয়েছে আগের রায় ছিল রাজনৈতিক প্রভাবিত ও প্রহসনমূলক। আজহারুল ইসলামের মুক্তির মাধ্যমে সত্যের বিজয় হয়েছে।
এই রায় শুধু একজন ব্যক্তির মুক্তির খবর নয়; এটি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-প্রক্রিয়ার ইতিহাসে নতুন দিকচিহ্ন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা দণ্ডিত হয়েছেন। তবে এই প্রথম একজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অভিযুক্ত আপিল বিভাগের রায়ে সম্পূর্ণ খালাস পেলেন।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রায়ের ফলে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা, সাক্ষ্য-প্রমাণের মান ও আপিল বিভাগের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হবে।
রায় নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা আলোচনা শুরু হলেও, এটুকু স্পষ্ট- একটি দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার পর দেশের সর্বোচ্চ আদালত একটি সাহসী ও ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন। এর ফলে এটিএম আজহারুল ইসলামের মুক্তিতে আর কোনো বাধা থাকলো না। এখন দেখার বিষয়- এই রায়ের প্রভাব ভবিষ্যতের বিচার কার্যক্রম ও রাজনৈতিক আবহে কেমনভাবে প্রতিফলিত হয়।
বাংলাধারা/এসআর