ঢাকা, সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫, ২ আষাঢ় ১৪৩২

সি চিন পিংয়ের কন্যাকে বহিষ্কারের দাবি: হঠাৎ কেন যুক্তরাষ্ট্রে এই বিতর্ক?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

 প্রকাশিত: মে ৩১, ২০২৫, ০৭:৩৮ বিকাল  

ছবি: সংগৃহিত

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের একমাত্র কন্যা সি মিং জেকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কারের দাবি তুলে তীব্র আলোচনার জন্ম দিয়েছেন দেশটির কট্টর ডানপন্থী রাজনৈতিক ভাষ্যকার লরা লুমার। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ দাবি করেছেন, সি মিং জে এখনো ম্যাসাচুসেটসে অবস্থান করছেন এবং চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির (PLA) সদস্যদের দ্বারা সুরক্ষিত। যদিও এ দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ তিনি উপস্থাপন করেননি।

সি মিং জে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এবং জনপ্রিয় লোকসংগীতশিল্পী পেং লিউয়ানের একমাত্র সন্তান। ১৯৯২ সালে জন্ম নেওয়া মিং জে ছদ্মনামে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান ও ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক পড়াশোনা করেন। ২০১৪ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনের একটি প্রতিবেদন জানায়, তিনি চীনে ফিরে গেছেন এবং এরপর থেকে অনেকটাই নিভৃতে জীবনযাপন করছেন।

হার্ভার্ডে পড়ার সময় মিং জে থাকতেন ঐতিহাসিক অ্যাডামস হাউসে- যেখানে একসময় ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ও হেনরি কিসিঞ্জারের মতো ব্যক্তিরাও ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পরিচয় ছিল সীমিত পরিসরে জানা- মাত্র কয়েকজন শিক্ষক ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছাড়া কেউই জানতেন না, তিনিই চীনা প্রেসিডেন্টের কন্যা। এক জাপানি সাংবাদিকের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি অত্যন্ত নির্লোভ, মিতব্যয়ী ও অধ্যয়ননিষ্ঠ জীবন যাপন করতেন।

লরা লুমার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ এক পোস্টে দাবি করেন, “সি চিন পিংয়ের কন্যা এখনো ম্যাসাচুসেটসে রয়েছেন এবং PLA-এর নিরাপত্তায় আছেন। তাঁকে বহিষ্কার করা হোক!” তিনি এই দাবির সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওসহ যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিদের ট্যাগ করেন এবং তাঁর সমর্থকদের এই ইস্যু সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল করার আহ্বান জানান।

এই দাবি এমন এক সময় এসেছে, যখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যে শিক্ষার্থী ভিসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে আইনগত লড়াই চলছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে চীনা শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিয়ে রিপাবলিকানদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে।

সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ঘোষণা দিয়েছেন, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিল করা শুরু করবে যুক্তরাষ্ট্র। তিনি এক্সে লিখেছেন, “যেসব শিক্ষার্থীর CCP-এর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে বা যারা স্পর্শকাতর বিষয়ে পড়ছে, তাদের ভিসা বাতিল করা হবে।”

এছাড়া সিনেটর এরিক শ্মিট মার্কিন কংগ্রেসে ‘প্রোটেক্টিং হায়ার এডুকেশন ফ্রম দ্য চায়নিজ কমিউনিস্ট পার্টি অ্যাক্ট’ নামে একটি বিল উত্থাপন করেছেন। বিলটি CCP সদস্য এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জন্য মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রভিসা বন্ধের আহ্বান জানায়।

ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের তথ্যানুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি সম্পন্নকারী চীনা শিক্ষার্থীদের প্রায় ৯২ শতাংশই ডিগ্রি অর্জনের পাঁচ বছর পরও যুক্তরাষ্ট্রে থেকে যান। তুলনায় দক্ষিণ কোরিয়ানদের মধ্যে এ হার ৪১ শতাংশ।

আমেরিকান ইমিগ্রেশন কাউন্সিলের সিনিয়র ফেলো অ্যারন রিখলিন-মেলনিক বলেন, “বিদেশি শিক্ষার্থীদের প্রবেশে বাধা দিলে মার্কিন অর্থনীতির উপর এর প্রভাব হবে মারাত্মক।” তিনি মনে করিয়ে দেন, এই খাত যুক্তরাষ্ট্রে বছরে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক অবদান রাখে এবং সাড়ে তিন লাখের বেশি চাকরি সৃষ্টি করে।

এই পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করেছে যাতে শিক্ষাক্ষেত্রে কোনো ধরনের ব্যাঘাত না ঘটে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি শিক্ষা ও একাডেমিক বিনিময়ে কোনো বাধা দেওয়া উচিত নয়। আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে আহ্বান জানাই, তারা যেন চীনা শিক্ষার্থীসহ সব আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর অধিকার রক্ষা করে।”

সি মিং জে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন- এমন কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই। কিন্তু তাঁকে ঘিরে এই বিতর্ক যেন বড় কোনো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের অংশ। লুমারের অভিযোগ ও রুবিওদের নীতিমালার প্রস্তাব একসঙ্গে মিলিয়ে দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়, আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে চীনবিরোধী অবস্থানকে সামনে এনে রিপাবলিকানরা জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছেন। চীনের শীর্ষ নেতার কন্যাকে যুক্তরাষ্ট্রে দেখানোর মাধ্যমে তাঁরা চীনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন একসূত্রে টেনে আনছেন।

হার্ভার্ডে পড়াশোনা করলেও সি মিং জে কোনো অপরাধে জড়িত ছিলেন না, এমনকি তাঁর উপস্থিতি এতটাই নিভৃত ছিল যে তাঁকে সাধারণ শিক্ষার্থী বলেই মনে হতো। ফলে, তাঁকে কেন্দ্র করে এই বিতর্ক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কি না, তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে।

 

বাংলাধারা/এসআর