ঢাকা, শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

মরক্কোতে কোরবানি নিষেধাজ্ঞা: মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

 প্রকাশিত: জুন ০৫, ২০২৫, ০৬:১৭ বিকাল  

ছবি: সংগৃহিত

আফ্রিকার উত্তর-পশ্চিমের দেশ মরক্কোতে এবছর ঈদুল আজহায় পশু কোরবানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। দেশটির রাজা মোহাম্মদ ষষ্ঠ-এর এই সিদ্ধান্তকে ঐতিহাসিক ও মানবিকতার এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। চলমান অর্থনৈতিক মন্দা, কৃষি খাতের বিপর্যয় এবং দীর্ঘদিনের খরার কারণে পশুসম্পদের সংকট-সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

ঈদুল আজহা মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব, যার মূল আচার হচ্ছে পশু কোরবানি। মরক্কোতেও প্রতিবছর লাখো মানুষ এই ধর্মীয় রীতি পালন করে আসছে। কিন্তু ২০২৫ সালের ঈদ, যা অনুষ্ঠিত হবে ৭ জুন, সেখানে সেই চেনা দৃশ্য আর থাকছে না।

সাত বছরের টানা খরায় মরক্কোর পশুসম্পদ প্রায় ৩৮ শতাংশ কমে গেছে। গতবছর একেকটি সাধারণ ভেড়ার দাম পৌঁছায় ৬০০ ডলার পর্যন্ত, যেখানে দেশের ন্যূনতম মাসিক মজুরি মাত্র ৩৩৫ ডলার (৩১০০ দিরহাম)। এই অর্থনৈতিক ব্যবধান নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য কোরবানি প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে।

এমন কঠিন বাস্তবতায়, রাজা মোহাম্মদ ষষ্ঠ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এক চিঠির মাধ্যমে ঘোষণা দেন—এই বছর সাধারণ জনগণ কোরবানি থেকে বিরত থাকবে। বরং তিনি নিজেই দেশের পক্ষ থেকে ঈদের প্রতীকী কোরবানি সম্পন্ন করবেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, এই পরিস্থিতিতে কোরবানির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জনগণের কষ্ট লাঘব ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা।

এই সিদ্ধান্ত ১৯৬০-এর দশকের পর এই প্রথমবার কোনো রাজা কোরবানি নিষিদ্ধ করলেন, যখন মরহুম রাজা হাসান দ্বিতীয় একইরকম নির্দেশ দিয়েছিলেন।

অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ জাদরি মনে করেন, এই সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের জন্য স্বস্তির বার্তা এনেছে। গতবছর বহু মানুষ উচ্চমূল্যে পশু কিনে ঋণের বোঝায় পড়ে গিয়েছিল। এবার তারা সে চাপ থেকে মুক্ত।

তবে অন্যদিকে, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন খামারিরা, যাঁদের আয় পুরোপুরি ঈদ মৌসুমে পশু বিক্রির ওপর নির্ভরশীল। প্রতি বছর মরক্কোতে গড়ে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার পশু কোরবানি হয়। এবার সেই বাজার পুরোপুরি স্তব্ধ।

এই সংকটে কৃষকদের সহায়তায় সরকার ৭০০ মিলিয়ন দিরহাম (৭৬.৫ মিলিয়ন ডলার) বরাদ্দ দিয়েছে। এর আওতায় ৫০ হাজার খামারির ঋণ মওকুফ, গর্ভবতী গবাদিপশুর নিবন্ধন, এবং নির্দিষ্ট ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

এবার ঈদ ঘিরে শহরের সুপারমার্কেটে নেই কোরবানির সামগ্রীর প্রচার-প্রচারণা- নেই ছুরি, বারবিকিউ যন্ত্রপাতির বিশাল বিজ্ঞাপন। অনেকের মনেই তাই প্রশ্ন, সত্যিই কি ঈদ আসছে?

তবে কিছু বিত্তবান পরিবার কোরবানি চালিয়ে যাচ্ছে, কেউ কেউ সরকারি অনুমোদিত স্লটারহাউসে গোপনে কোরবানি দিচ্ছেন। এতে সামাজিক অসাম্য ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। যদিও কেউ কেউ সেই কোরবানির মাংস গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, সমাজে সমতা বজায় রাখতে।

রাবাতের বাসিন্দা ফাতিমা বলেন, “এই সিদ্ধান্তে আমি গর্বিত। ধর্মীয় অনুশীলন মানেই কেবল রীতিনীতি নয়- মানবিকতা, সহানুভূতি, আর সমবেদনা এতে আরও বেশি জরুরি।”

অক্সফামের ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, উত্তর আফ্রিকায় আয়বৈষম্য হ্রাসের ক্ষেত্রে মরক্কো দ্বিতীয় সর্বনিম্ন স্থানে রয়েছে। এবারের ঈদ সেই বৈষম্য ঘোচানোর প্রয়োজনীয়তা আরও জোরালোভাবে সামনে এনেছে।

এই বছর কোরবানি না হলেও মরক্কোবাসী ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না। নামাজ, পরিবারিক মিলন, একে অপরকে সাহায্য করা, এবং সহানুভূতির চর্চা- এসবের মধ্য দিয়েই মানুষ ঈদের প্রকৃত অর্থ অনুধাবনের চেষ্টা করছে।

রাজা মোহাম্মদ ষষ্ঠ-এর এই সিদ্ধান্ত প্রমাণ করেছে- ধর্মীয় মূল্যবোধ কেবল আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা হতে পারে সামাজিক ন্যায়ের এক বলিষ্ঠ হাতিয়ার।


বাংলাধারা/এসআর