ঢাকা, শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

আঞ্চলিক শান্তিতে ঐকমত্য চান শিগেরু: ড. ইউনূসকে জাপানের বার্তা

নিউজ ডেস্ক

 প্রকাশিত: জুন ০২, ২০২৫, ০২:১৬ রাত  

ছবি: পিআইডি

টোকিওতে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে উঠে এসেছে আঞ্চলিক শান্তি, অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব এবং কৌশলগত সহযোগিতার নানা দিক। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরুর মধ্যে অনুষ্ঠিত এ বৈঠককে ঘিরে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে আঞ্চলিক সহযোগিতা ও ভারসাম্যের বার্তা।

জাপানের স্থানীয় সময় শুক্রবার (৩০ মে) টোকিওতে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকটি চলে প্রায় আধা ঘণ্টা। বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক, প্রতিরক্ষা, ইন্দো-প্যাসিফিক, রোহিঙ্গা ইস্যু, মানবসম্পদ উন্নয়নসহ একাধিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।

জাপানের প্রধানমন্ত্রী কোনো নির্দিষ্ট দেশের নাম উল্লেখ না করলেও, তিনি আঞ্চলিক সহযোগিতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, "বাংলাদেশ যেন সবার সঙ্গে মিলে কাজ করে- এটাই জাপানের প্রত্যাশা।" বিশ্লেষকদের মতে, শিগেরুর এই মন্তব্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্য বজায় রাখার গুরুত্বই ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমদ মনে করেন, “জাপানের সঙ্গে মিয়ানমারের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। করিডর ও আরাকান ইস্যুতে মিয়ানমার অসন্তুষ্ট- এই প্রেক্ষাপটে জাপান হয়তো বাংলাদেশকে মনে করিয়ে দিতে চায়, আঞ্চলিক ঐকমত্যই এখন জরুরি। ভারতের সঙ্গে জাপানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও এই বার্তার পেছনে কাজ করেছে।”

সরকারপ্রধানের সফরে দুই দেশের মধ্যে মোট ছয়টি সমঝোতা স্মারক (MoU) সই হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:

☑️ বাংলাদেশের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ও জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এর মধ্যে MoU।

☑️ বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (BSEZ) জমি ইজারার জন্য ওনোডা ইনকরপোরেশন ও ন্যাক্সিস কোম্পানি লিমিটেড এর সঙ্গে পৃথক দুটি চুক্তি।

☑️ গ্লাগিট, মুসাশি সেইমিৎসু ও বিডা-এর মধ্যে একটি প্রযুক্তি বিনিয়োগচুক্তি।

☑️ সাইবার নিরাপত্তা খাতে ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ করবে সাইফার কোর কোম্পানি লিমিটেড।

☑️ জাইকা ও বিডা এর মধ্যে চুক্তি বিনিময়।

জাপান সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে বাজেট সহায়তা, রেলপথ উন্নয়ন ও জলবায়ু স্থিতিশীলতায় ১০৬ কোটি ৩০ লাখ ডলারের ঋণের ঘোষণা দেওয়া হয়। এর মধ্যে:

  • ৪১ কোটি ৮০ লাখ ডলার: অর্থনৈতিক সংস্কার ও জলবায়ু স্থিতিশীলতার জন্য উন্নয়ন ঋণ।
  • ৬৪ কোটি ১০ লাখ ডলার: জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী রেলপথ ডুয়াল গেজ ডাবল লাইনে রূপান্তরের জন্য।
  • ৪২ লাখ ডলার: শিক্ষাবৃত্তি অনুদান।

বৈঠক শেষে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি হস্তান্তর বিষয়ে উভয় দেশ নীতিগতভাবে একমত হয়েছে এবং দ্রুত একটি চুক্তি সম্পন্ন করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। এছাড়া, বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে পাঁচটি টহল নৌকা সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে জাপানের অফিশিয়াল সিকিউরিটি অ্যাসিস্ট্যান্সের আওতায়।

যৌথ বিবৃতিতে রোহিঙ্গা শব্দটি না উল্লেখ করে বলা হয়, “বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের মিয়ানমারে স্বেচ্ছাসেবী, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন” নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কূটনৈতিকভাবে সংবেদনশীল এই শব্দচয়ন পরিপক্বতা ও কৌশলগত ভারসাম্যের ইঙ্গিত দেয়।

বৈঠকে জাপান ও বাংলাদেশ তাদের কৌশলগত অংশীদারত্ব পুনর্ব্যক্ত করে। তারা মুক্ত, অবাধ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রতি সমর্থন জানায়, যা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।

জাপান বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগে সহযোগিতা আরও বাড়াবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। একইসঙ্গে বিনিয়োগ সহজ করতে ওয়ান স্টপ সার্ভিস (OSS), প্রি-পেইড গ্যাস মিটার, ব্যাটারি চালিত বাইক কারখানা, তথ্য নিরাপত্তার পাইলট প্রকল্প এবং বিএসইজেড-এর ভূমি চুক্তিসহ একাধিক বিষয়ে সম্মতি দেয় উভয়পক্ষ।

ড. ইউনূস বৈঠকে মহেশখালী-মাতারবাড়ি সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন (MIDI) এবং বঙ্গোপসাগরীয় শিল্প বৃদ্ধি বেল্ট (BIG-B) প্রকল্পে জাপানের অব্যাহত সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

যদিও অনেক চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে, আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ইমতিয়াজ আহমদের মতে, “এই সফরে কোনো নতুন চুক্তি হয়নি, বরং এটি একটি প্রোটোকল সফর ছিল। বিদেশি শক্তিগুলো এখনো অপেক্ষা করছে নির্বাচিত সরকারের জন্য।”

ড. ইউনূসের টোকিও সফরে জাপানের পক্ষ থেকে আঞ্চলিক শান্তি ও সহযোগিতা নিয়ে যে বার্তা দেওয়া হয়েছে, তা কেবল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নয়, বরং বড় পরিসরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশ কী ভূমিকা নেবে সেই প্রশ্নও সামনে নিয়ে আসে। অর্থনৈতিক বিনিয়োগ, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ও কৌশলগত সংলাপ- সব মিলিয়ে এ সফর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি সতর্ক, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হয়ে থাকবে।


বাংলাধারা/এসআর