নিবন্ধনের হিড়িক, নেই দলের অস্তিত্বই
প্রকাশিত: জুন ০৩, ২০২৫, ০৫:৪৬ বিকাল

ফাইল ছবি
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দরজায় ভিড় করছেন ‘নতুন বাংলা’, ‘বাংলাদেশ একুশে পার্টি’, ‘জাগ্রত জনতা পার্টি’, কিংবা ‘ছাত্র জনতা পার্টি’র মতো নামধারী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ৬৫টি দল নিবন্ধনের আবেদন জমা দিয়েছে ইসিতে। অথচ এই দলগুলোর বেশিরভাগেরই নেই কোনো স্থায়ী দলীয় কার্যালয়, নেই সাংগঠনিক কাঠামো, নেই মাঠপর্যায়ে তৎপরতা- আছে কেবল নামে-ভূষায় দল গঠনের কাগুজে স্বপ্ন।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, একাধিক নিবন্ধন প্রত্যাশী দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কোনো অস্তিত্বই নেই। কোথাও নেই সাইনবোর্ড, কোথাও আবার তালাবদ্ধ নির্জন কক্ষ। কিছু কার্যালয়ে ঢুকেও দেখা যায় মাত্র একটি টেবিল আর কয়েকটি চেয়ার; কার্যক্রম বলতে কিছুই নেই। দলের লোকজন তো দূরের কথা, আশপাশের মানুষও জানেন না এখানে কোনো রাজনৈতিক দলের অফিস আছে।
মিরপুরের আহমেদনগরের একটি বাড়ির নিচতলায় ‘বাংলাদেশ ছাত্র জনতা পার্টি’র ঠিকানা পাওয়া যায়। কিন্তু বাড়ির বাসিন্দারা জানান, তারা জানেন না এখানে কোনো রাজনৈতিক দলের অফিস আছে। পরে ওই বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখা যায় ছোট্ট একটি কক্ষে দুটি টেবিল আর কয়েকটি চেয়ার নিয়ে চলছে কথিত কার্যালয়। মুখপাত্র বেলাল হোসেন বলেন, “এটা আমাদের অস্থায়ী অফিস। গোডাউনের মতো জায়গা। একটু একটু করে পরিষ্কার করছি, পরে এটাকেই স্থায়ী অফিস হিসেবে ব্যবহার করবো।”
এদিকে ‘নতুন বাংলা’ নামে একটি দলের কার্যালয় দেখা গেল বন্ধ। ডাকে সাড়া না পেয়ে আশপাশে জিজ্ঞেস করে দরজা খোলানো হলো। ভেতরে ঢুকে দেখা যায় একটি টেবিল আর কয়েকটি চেয়ার ছাড়া আর কিছুই নেই। নেই কোনো কর্মী, নেই কার্যক্রমের চিহ্ন।
এভাবেই রাজধানীজুড়ে দেখা মিলেছে এমন বহু নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দলের- যাদের অফিস আছে কেবল কাগজে-কলমে। কোনো কোনো দল তো কেবল একটি কক্ষে একটি চেয়ার-টেবিল বসিয়ে দুধারে দুইটি সেলফি তুলে দিয়েই দাবি করছে, এটাই নাকি তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়।
পল্টনের একটি ভবনে একই ছাদের নিচে চলছে একাধিক দল- ‘লেবার পার্টি বাংলাদেশ’, ‘আমজনতার দল’, ‘দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলন’। কিন্তু ভেতরে ঢুকে চোখে পড়ে শূন্যতা, নেই কোনো আলোচনার টেবিল, নেই রাজনৈতিক পোস্টার কিংবা কর্মীদের আনাগোনা। ‘দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলন’-এর সভাপতি রফিকুল ইসলাম রিপনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো ব্যাখ্যা না দিয়েই ফোন রেখে দেন।
নির্বাচন কমিশনের আইন অনুযায়ী, নতুন কোনো দল নিবন্ধনের জন্য কমপক্ষে ২১টি জেলায় সংগঠনিক কাঠামো ও কার্যালয় থাকতে হবে এবং কমপক্ষে ১০০টি উপজেলায় সক্রিয় কমিটি থাকতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। যখন কেন্দ্রীয় কার্যালয়েরই নেই কোন অস্তিত্ব, তখন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কার্যক্রমের দাবি কতটা বিশ্বাসযোগ্য, তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক বদিউল আলম মজুমদার বলছেন, “এসব ছোট ছোট দল অনেক সময় বড় দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতায় যায়। একেকটি আসনের বিনিময়ে তারা রাজনৈতিক ব্যবসা করে। কেউ কেউ আবার সত্যিই বিশ্বাস করেন, দল গড়েই রাজনীতিতে পরিবর্তন আনা সম্ভব। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, অধিকাংশ দলই কাগুজে- নেতাকর্মী নেই, জনসম্পৃক্ততা নেই, তবুও নিবন্ধনের দৌড়ে তারা।”
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আব্দুল লতিফ মাসুম বলেন, “রাজনীতির নামে ব্যবসা, নেতৃত্বের মোহ আর জোটে ঠাঁই পাওয়ার আশাই এ ধরনের দল গঠনের পেছনে মূল চালিকা শক্তি। বড় বড় দলগুলোও অনেক সময় এসব দলকে ব্যবহার করে নিজেদের জোটকে ভারী দেখাতে। তাই দায় শুধু নামসর্বস্ব দলগুলোর নয়, বড় দলগুলোও এ প্রক্রিয়ায় দায় এড়াতে পারে না।”
নিবন্ধনের জন্য সময় বাড়াতে ৪৫টি দল নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছে। কমিশন সময়সীমা বাড়িয়ে দিয়েছে ২২ জুন পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে দলগুলোকে প্রমাণ করতে হবে তাদের সাংগঠনিক তৎপরতা, মাঠপর্যায়ের কাঠামো ও জনসম্পৃক্ততা। কিন্তু এতসব ‘যদি-কিন্তু’র মাঝে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে- এসব দল কি আদৌ গণতন্ত্র ও জনসেবার নামে নিবন্ধন চাইছে, নাকি শুধুই সুবিধা অর্জনের আশায় রাজনৈতিক ঠিকানা খুঁজছে?
নিবন্ধনের তালিকায় থাকা এসব দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন এখন রাজনৈতিক মহল থেকে সাধারণ জনগণ পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত কতটি দল এই শর্ত পেরিয়ে ইসির নিবন্ধন পায়- তা-ই এখন দেখার বিষয়।
বাংলাধারা/এসআর