শিরিন-ইসমাইলদের ভরসায় কি ঘুরে দাঁড়াবে অ্যাথলেটিক্স?
প্রকাশিত: জুন ১৬, ২০২৫, ১১:৪৬ দুপুর

ফাইল ছবি
বাংলাদেশের অ্যাথলেটিক্সে এক ধরনের নিরব মৃত্যুযাত্রা চলছে- যার প্রমাণ, একেকটি জাতীয় রেকর্ড ভাঙতে লাগছে তিন দশকেরও বেশি সময়! এই দীর্ঘ অপেক্ষার পেছনে শুধু গতি বা প্রতিভার অভাব নয়, রয়েছে কাঠামোগত অব্যবস্থা, পৃষ্ঠপোষকতার সংকট আর পরিকল্পনার ঘাটতি।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় একটি বড় খবর ছিল পুরোনো রেকর্ড ভাঙা। সেনাবাহিনীর নাজমুল হোসেন রনি ৪০০ মিটার স্প্রিন্টে সময় নিয়েছেন ৫০.৮৪ সেকেন্ড- ভেঙেছেন ১৯৯৩ সালে আবদুর রহিমের গড়া ৩২ বছরের পুরোনো রেকর্ড। অথচ এই রেকর্ড ভাঙার মধ্য দিয়েই দেশের অ্যাথলেটিক্সের করুণ অবস্থার চিত্রই যেন আরও স্পষ্ট হলো।
নারী বিভাগেও রেকর্ড হয়েছে। সেনাবাহিনীর বর্ষা খাতুন মেয়েদের ৪০০ মিটার হার্ডলসে সময় নিয়েছেন ১ মিনিট ০৪.৬১ সেকেন্ড। এর আগে ২০২২ সালে লিবিয়া খাতুন করেছিলেন ১:০৪.৭০। মেয়েদের ৪x৪০০ মিটার রিলেতে ৩১ বছর পর পুরোনো রেকর্ড ছাপিয়ে যান নৌবাহিনীর শিরিন, সোহা, রুনা ও নাথেরা। অথচ, এইসব অর্জন একটাই প্রশ্ন সামনে আনে- তিন দশক ধরে কি দেশের ট্র্যাকে কারও গতি বাড়ল না?
স্প্রিন্ট ইভেন্টে দেশের মানচিত্র একেবারে অসাড়। এবার দ্রুততম মানব হলেন মো. ইসমাইল, যার সময় ১০.৬১ সেকেন্ড। গত তিন বছর ইমরানুর রহমানের অনুপস্থিতিতে আবারও পুরোনো চ্যাম্পিয়নের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে- যা নতুনদের অক্ষমতারই প্রমাণ।
আর মেয়েদের দিকেও একই অবস্থা। শিরিন আক্তার টানা ১৬ বছর দেশের দ্রুততম মানবীর মুকুট ধরে রেখেছেন। ইলেকট্রনিক টাইমিংয়ে তার সময় ১২.০১ সেকেন্ড। তার পরবর্তী প্রতিদ্বন্দ্বী সুমাইয়ার সময় ১২.১৫ সেকেন্ড। এই সামান্য ব্যবধানই যেন দেশের নারী স্প্রিন্টের মেরুদণ্ডহীন অবস্থার প্রতিচ্ছবি।
শিরিন আক্তার বললেন, “আমি তো এখনো চ্যাম্পিয়ন। হারানোর মতো কেউ নেই বলেই তো আমি থামছি না। দেশের জন্য একটা আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদক এনে দিতে চাই। তারপর থামার কথা ভাবব।” প্রশ্ন উঠতেই পারে—১৬ বছরে একজন প্রতিদ্বন্দ্বীও তৈরি হলো না?
একসময় সাফ গেমস থেকে শুরু করে এশিয়ান প্রতিযোগিতায় দেশের অ্যাথলেটিক্সে ছিল গর্ব করার মতো সাফল্য। শাহ আলম, বিমল তরফদার কিংবা মাহবুবদের হাত ধরে লাল-সবুজ পতাকা উড়ত আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে। অথচ, ২০১০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এসএ গেমসেও বাংলাদেশ কোনো স্বর্ণপদক পায়নি। সর্বোচ্চ অর্জন ছিল হার্ডলার সুমিতার একটি রুপা।
সেই থেকে শুরু হয়েছে দীর্ঘ নীরবতা, যা এখনও কাটেনি। অথচ কোনো কাঁপুনি নেই অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনে। যেন হার-পরাজয়, পতন কিছুই তাদের স্পর্শ করে না।
প্রশ্ন উঠছে- কেন এমন হচ্ছে? বিশ্লেষণে উঠে আসে প্রধান দুটি কারণ:
- জীবিকার অনিশ্চয়তা:
অ্যাথলেটদের সবচেয়ে বড় সমস্যা জীবিকার নিশ্চয়তা। একসময় যেসব প্রতিষ্ঠান যেমন কাস্টমস, বিজেএমসি, বিটিএমসি ক্রীড়াবান্ধব ছিল, এখন তারা খেলাধুলা থেকে পুরোপুরি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। মিলজার হোসেন, যিনি ১৯৮৬ সালে এশিয়ান গেমসে ৮০০ মিটারে পঞ্চম হয়েছিলেন, আফসোস করে বলেন, “খুলনায় একসময় অ্যাথলেট তৈরি হতো, এখন সেই উৎস বন্ধ। পাটকল বন্ধ হয়ে গেছে, চাকরি নেই, ভাতা নেই। মাঠে ধান কেটে এসে খালি পেটে দৌড়ানো যায়?” - স্কুল-কলেজ পর্যায়ে অবহেলা:
একসময় স্কুল-কলেজে অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতা নিয়মিত হতো। সেখান থেকেই উঠে আসতেন সম্ভাবনাময় প্রতিভারা। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্পোর্টসের জায়গা হয়েছে কোচিং আর গাইড বইয়ের নিচে। ফলে নতুন প্রজন্ম ট্র্যাকে আসছেই না।
পুরোনো রেকর্ড ভাঙা মানেই কি ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত? না, বরং সেটা বলে দেয় কতটা পিছিয়ে পড়েছি আমরা। এ এক ধরনের ‘রেট্রো অ্যাচিভমেন্ট’, যা গৌরবের নয় বরং লজ্জার। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেখানে অ্যাথলেটরা ১০ সেকেন্ডের নিচে স্প্রিন্ট করছেন, সেখানে আমরা ১০.৬১ সেকেন্ডে হাততালি দিচ্ছি!
তবে আশা একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় যেসব সেনাবাহিনী বা নৌবাহিনীর অ্যাথলেট রেকর্ড গড়ছেন, তারা প্রমাণ করছেন- উপযুক্ত পরিবেশ পেলে বাংলাদেশের তরুণরাও পারবে।
বাংলাদেশের অ্যাথলেটিক্সের জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি একটি পূর্ণসংখ্যার পুনর্গঠন- যেখানে থাকবে পরিকল্পিত কোচিং, স্কুল পর্যায়ে প্রতিযোগিতা, এবং খেলোয়াড়দের জন্য স্থায়ী পেশাগত নিরাপত্তা। না হলে একেকটি পুরোনো রেকর্ড ভাঙা শুধু অতীতের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলার উপলক্ষ হয়েই থাকবে।
বাংলাধারা/এসআর