ঢাকা, শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

এক জন্ম, বহু চরিত্র- শুভ জন্মদিন হুমায়ুন ফরীদি

বিনোদন ডেস্ক:

 প্রকাশিত: মে ২৯, ২০২৫, ১০:০৩ দুপুর  

ফাইল ছবি

আজ ২৯ মে- বাংলাদেশের অভিনয় জগতের এক অনন্য তারকা, কিংবদন্তি অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদির জন্মদিন। তিনি বেঁচে থাকলে আজ ৭৪ বছরে পা রাখতেন। শিল্পী হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন এক অনন্য প্রতিভা, যিনি নাটক, সিনেমা ও মঞ্চ- তিন মাধ্যমেই দাপটের সঙ্গে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। লাখো-কোটি দর্শকের হৃদয়ে গেঁথে আছেন আজও।

১৯৫২ সালের ২৯ মে, পুরান ঢাকার নারিন্দায় জন্ম নেন হুমায়ুন ফরীদি। বাবা এ টি এম নুরুল ইসলাম ছিলেন জুরি বোর্ডের কর্মকর্তা, আর মা বেগম ফরিদা ইসলাম ছিলেন একজন গৃহিণী। বাবার চাকরির বদলির সুবাদে ছোটবেলা থেকেই দেশের নানা জেলায় ঘুরে বেড়াতে হয় ফরীদিকে—মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুর প্রভৃতি তার স্মৃতিময় স্থান।

মাদারীপুর ইউনাইটেড ইসলামিয়া গভর্নমেন্ট হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক শেষ করে তিনি ভর্তি হন চাঁদপুর সরকারি কলেজে। ১৯৭০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্গানিক কেমিস্ট্রি বিভাগে। কিন্তু ১৯৭১ সালে দেশ মাতৃকার টানে ঝাঁপিয়ে পড়েন মহান মুক্তিযুদ্ধে। নয় মাসের যুদ্ধ শেষে বিজয়ী হয়ে ঢাকায় ফিরলেও আর ফিরে যাননি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এরপর পাঁচ বছর বোহেমিয়ান জীবনের পর ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। এখানেই শুরু হয় তার নাট্যচর্চার পথচলা। নাট্যকার সেলিম আল দীনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করতে থাকেন তিনি। ১৯৭৬ সালে জাহাঙ্গীরনগরে প্রথম নাট্যোৎসব আয়োজনের মূল সংগঠক ছিলেন ফরীদি। ‘আত্মস্থ ও হিরন্ময়ীদের বৃত্তান্ত’ নামে একটি নাটক লিখে নির্দেশনা দেন এবং অভিনয়ও করেন।

১৯৭৬ সালেই তিনি যোগ দেন ঢাকা থিয়েটারে। তবে মঞ্চে অভিষেক ঘটে অনেক আগেই—মাত্র ১২ বছর বয়সে, ১৯৬৪ সালে, কিশোরগঞ্জে মহল্লার নাটক ‘এক কন্যার জনক’-এ। ঢাকা থিয়েটারে ফরীদির উল্লেখযোগ্য মঞ্চনাটকের মধ্যে আছে—‘শকুন্তলা’, ‘ফণিমনসা’, ‘কীত্তনখোলা’, ‘মুন্তাসির ফ্যান্টাসি’, ‘কেরামত মঙ্গল’ ইত্যাদি। ১৯৯০ সালে তিনি নিজের নির্দেশনায় ‘ভূত’ নাটকের মধ্য দিয়ে থিয়েটারের সঙ্গে তার সম্পর্কের ইতি টানেন।

টেলিভিশনে তার অভিষেক হয় আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজিত ‘নিখোঁজ সংবাদ’ নাটকের মাধ্যমে। কিন্তু দর্শকের মনে স্থায়ী জায়গা করে নেন ১৯৮৩ সালে প্রচারিত ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’ নাটকে ‘সেরাজ তালুকদার’ চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে। সেলিম আল দীনের লেখা ও নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর পরিচালনায় এই নাটকে ফরীদি হয়ে ওঠেন টুপি-দাড়িওয়ালা এক ভয়ঙ্কর চরিত্র, যার সংলাপ আজও মানুষের মুখে ফেরে—

“আরে আমি তো জমি কিনি না, পানি কিনি, পানি”
“দুধ দিয়া খাইবা না পানি দিয়া খাইবা বাজান?”

এই সংলাপগুলো আশির দশকে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

চলচ্চিত্রে হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন এক অসামান্য শক্তি। ‘একাত্তরের যিশু’, ‘হুলিয়া’, ‘পলাতক’, ‘বিশ্বপ্রেমিক’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘সন্ত্রাস’, ‘ব্যাচেলর’, ‘জয়যাত্রা’, ‘মাতৃত্ব’, ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ সহ অসংখ্য সিনেমায় তার অভিনয় দেখলেই বোঝা যায়, একজন শিল্পী কেমন করে চরিত্রে ঢুকে যেতে পারেন।

হুমায়ুন ফরীদি ব্যক্তিগত জীবনে দুইবার বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে তার একমাত্র কন্যা ‘দেবযানী’র জন্ম। পরবর্তীতে বিখ্যাত অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেও ২০০৮ সালে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে।

২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, বসন্তের দিনেই বাংলা অভিনয়ের এক চিরসবুজ পাতার বিদায় ঘটে। ফাগুনের রঙিন বাতাসে বিষাদের ধোঁয়া ছড়িয়ে পৃথিবীকে বিদায় জানান এই কিংবদন্তি।

হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন কেবল একজন অভিনেতা নন, তিনি ছিলেন এক জীবন্ত অভিধান। বাংলা অভিনয়ের আকাশে তিনি ছিলেন ধ্রুবতারা। সময় যতই যাক, তার কণ্ঠ, চোখের ভাষা, সংলাপ উচ্চারণ কিংবা মঞ্চে দাঁড়িয়ে দাঁত চেপে বলা কোনো দৃপ্ত বাক্য আমাদের মনে বারবার ফিরে আসবে।

আজ তার জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করি হুমায়ুন ফরীদিকে। তার মতো অভিনেতা একবারই জন্ম নেন।

 

বাংলাধারা/এসআর