ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
সমঝোতা নিয়ে বিএনপির স্পষ্ট বার্তা চান শরিকরা, সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় যুগপৎ জোট
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৩, ২০২৫, ১২:১৫ দুপুর
ফাইল ছবি
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা হলেও বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর আসন সমঝোতা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এ নিয়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের জোটে ক্রমেই বাড়ছে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা। শরিক দলগুলো এখন আসন বণ্টন প্রশ্নে বিএনপির কাছ থেকে একটি স্পষ্ট ও চূড়ান্ত অবস্থান জানতে চায়। সেই অবস্থান জানার পরই তারা নিজেদের পরবর্তী রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করবে।
গত বুধবার যুগপৎ আন্দোলনের শরিক ২৯টি দলের শীর্ষ নেতাদের এক বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ প্রেক্ষাপটে বিএনপি গত বৃহস্পতিবার রাতে মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক ডাকলেও যুগপৎ আন্দোলনের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার অনুপস্থিতির কারণে বৈঠকটি শেষ পর্যন্ত হয়নি। মুলতবি ওই বৈঠক আজ শনিবার বেলা ১১টায় বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
জানা গেছে, আলোচনায় যদি সমঝোতা হয়, তাহলে জোটের ঐক্য রক্ষার স্বার্থে ঘোষিত কিছু আসনে প্রার্থিতার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনতে পারে বিএনপি। সে ক্ষেত্রে দু-একটি আসনে শরিকদের জন্য ইতিবাচক ঘোষণা আসার সম্ভাবনাও রয়েছে।
এদিকে নির্বাচনী সমঝোতা প্রশ্নে বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের মধ্যে সৃষ্ট দূরত্ব ও টানাপোড়েনের দিকে নিবিড় নজর রাখছে জামায়াতে ইসলামী। পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় আসন্ন নির্বাচনে জামায়াত বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দলটি ইতোমধ্যে যুগপৎ জোটের ‘মনোনয়নবঞ্চিত’ নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে বলে জানা গেছে। শেষ পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা না হলে এসব নেতাদের কাউকে কাউকে নিজেদের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী মাঠে নামানোর চিন্তাও করছে জামায়াত।
শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমাদের কোনো সমস্যা নেই। রাজনৈতিক দল বা জোটের মধ্যে এ ধরনের বোঝাপড়ার ঘাটতি থাকতেই পারে। আমরা এখনো চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা দিইনি। যারা যুগপৎ আন্দোলনে আমাদের সঙ্গে ছিলেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে অবশ্যই যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে। আমি আশাবাদী, কোনো সমস্যা থাকবে না এবং আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারব।
বিএনপি আসন্ন নির্বাচনকে ‘অত্যন্ত কঠিন’ হিসেবে দেখছে। সে কারণে মিত্রদের জন্য ছাড়া আসনগুলোতে জয়ের নিশ্চয়তা না থাকলে ঝুঁকি নিতে চায় না দলটি। পাশাপাশি সংশোধিত আরপিও অনুযায়ী জোটভুক্ত হলেও প্রতিটি দলকে নিজ নিজ প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে- এ বিষয়টিও বিএনপির কৌশল নির্ধারণে বড় প্রভাব ফেলছে।
দলটির নেতারা মনে করছেন, ধানের শীষ প্রতীকের পক্ষে যেভাবে নেতাকর্মীদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাঠে নামানো সম্ভব, অন্য দলের প্রতীকের ক্ষেত্রে তা অনেক কঠিন। ফলে শুধুমাত্র বিজয়ের বাস্তব সম্ভাবনা আছে- এমন শরিকদেরই আসন ছাড়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। তবে জোটের ঐক্য অটুট রাখতে যাদের আসন দেওয়া সম্ভব হবে না, ভবিষ্যতে সংসদের উচ্চকক্ষ বা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে মূল্যায়নের চিন্তাও রয়েছে।
নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি গত ৩ নভেম্বর প্রথম দফায় ২৩৭ আসন এবং ৪ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফায় আরও ৩৬ আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে। মোট ২৭২ আসনে প্রার্থিতা ঘোষণা হলেও এখনো ২৮টি আসন ফাঁকা রয়েছে। বিএনপির ভাষ্য অনুযায়ী, এসব আসনে মূলত শরিকদেরই নির্বাচন করার কথা।
তবে শরিক নেতাদের অভিযোগ, তাদের কাছ থেকে প্রার্থী তালিকা নেওয়ার পরও কোনো আলোচনা ছাড়াই ২৭২ আসনে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। এতে তারা বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ। বিশেষ করে অন্তত ছয়টি আসনে অনিবন্ধিত দল ও জোটের শীর্ষ নেতারা মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন, কিন্তু ওই আসনগুলোতে বিএনপি কাউকেই ছাড় দেয়নি।
এ পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণে গত বুধবার রাজধানীর তোপখানা রোডে শিশু কল্যাণ পরিষদে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণঅধিকার পরিষদ, গণফোরামসহ মোট ২৯টি দল বৈঠকে বসে। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়- আসন সমঝোতা নিয়ে বিএনপি কী ভাবছে, তা স্পষ্টভাবে জানতে চাওয়া হবে।
বৈঠকে অধিকাংশ নেতা মত দেন, তারা উচ্চকক্ষ নয়, সরাসরি নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদে যেতে চান। তাদের দাবি- রাজপথের আন্দোলন, ত্যাগ ও সংগ্রামের যথাযথ রাজনৈতিক মূল্যায়ন। তবে তীব্র অসন্তোষ থাকলেও আপাতত বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার মতো চরম সিদ্ধান্তে যাচ্ছে না শরিকরা। বরং ঐক্যের ভিত্তিতেই দাবি আদায়ের কৌশল নিয়েছে তারা।
গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, যারা সবচেয়ে কঠিন সময়ে রাজপথে লড়াই করেছেন, তাদের যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে। এটা কোনো দয়া নয়- এটা ন্যায্যতার প্রশ্ন। পার্লামেন্টেও লড়াইয়ের প্রতিনিধিত্ব থাকা জরুরি।”
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ৪০টির বেশি দল যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। সবাই নিপীড়ন সহ্য করেছে। এখন নির্বাচন সামনে- প্রত্যাশা থাকবেই। মূল প্রশ্ন হলো, শরিকদের জন্য কতটি আসন ছাড়া হবে। আমরা ন্যায্য সিদ্ধান্ত আশা করি।
২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি শরিকদের জন্য ৫৯টি আসন ছাড়লেও এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। সে সময় জামায়াত ছিল জোটে, এবার তারাই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই এবার শরিকদের জন্য আসন ছাড়ের সংখ্যা কমতে পারে। রাজনৈতিক মহলে আলোচনা রয়েছে- এই সংখ্যা ১৫টির মতো হতে পারে।
বিএনপির নেতৃত্বে নির্বাচনী জোট গঠনের প্রক্রিয়া এখনো চলমান। যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের পাশাপাশি জামায়াতের বাইরে দু-একটি ইসলামী দলও এই জোটে যুক্ত হতে পারে বলে রাজনৈতিক সূত্রে জানা গেছে।
বাংলাধারা/এসআর
