ত্রিদেশীয় প্রতারণার ফাঁদে রাশিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে বাংলাদেশিরা
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ০৬, ২০২৫, ১১:১২ দুপুর

ছবি: সংগৃহিত
উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভনে রাশিয়ায় গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ছেন অনেক বাংলাদেশি যুবক। বাবুর্চি কিংবা ক্লিনারের চাকরির আশ্বাসে প্রথমে নেওয়া হয় সৌদি আরবে। সেখানে কিছুদিন থাকার পর পাঠানো হয় রাশিয়ায়। পরে রুশ ভাষায় লেখা এক চুক্তিপত্রে সই করিয়ে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় সেনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। কয়েক সপ্তাহের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ শেষে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে।
বিপজ্জনক আবহাওয়া ও ভারী অস্ত্র হাতে নিয়ে লড়াই করতে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকে। ইতোমধ্যে অন্তত চার বাংলাদেশির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হয়েছে। তারা হলেন নরসিংদীর সোহান মিয়া, ময়মনসিংহের ইয়াসিন মিয়া শেখ, নাটোরের হুমায়ুন কবির এবং তার ভগ্নিপতি রহমত আলী। কেউ কেউ আহত হয়ে দেশে ফিরেছেন, কেউবা সুযোগ বুঝে পালাতে সক্ষম হয়েছেন।
রাশিয়া থেকে বেঁচে দেশে ফেরা নরসিংদীর আকরাম হোসেন জানান, তিনি বনানীর ‘ড্রিম হোম ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস লিমিটেড’ নামে একটি এজেন্সির মাধ্যমে ৮ লাখ টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। প্রতিশ্রুতি ছিল মাসে দেড় থেকে দুই হাজার ডলার বেতনের চাকরি। কিন্তু সৌদি আরব হয়ে রাশিয়ায় গিয়ে বুঝতে পারেন, কাজ নয়-যুদ্ধে নামতেই তাদের নেওয়া হয়েছে।
যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা যশোরের জাফর আলী এক ভিডিও বার্তায় জানান, প্রশিক্ষণ শেষে তাদের সরাসরি ফ্রন্টলাইনে পাঠানো হয়। যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানালে মারধর করা হয় এবং হত্যা করার হুমকি দেওয়া হয়। তিনি বলেন, “আমাদের বন্দুক, গুলি আর গ্রেনেড দিয়ে বলেছে,‘যুদ্ধে যাও’। না গেলে গুলি করবে বলেছে। বোমার আঘাতে আমার কমান্ডার মারা গেছে, আমি আহত হয়েছি। সহযোদ্ধাদের মরতে দেখেছি।” তিনি বাংলাদেশের সরকারের প্রতি প্রাণ নিয়ে দেশে ফেরার আকুতি জানান।
যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়া বিদেশি যোদ্ধাদের অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে লোভনীয় প্রস্তাব দেয়। এককালীন প্রায় ৩০ লাখ টাকা, মাসে দুই লাখ টাকার সমপরিমাণ বেতন, আহত হলে বিনামূল্যে চিকিৎসা এবং নিহত হলে পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশি ভুক্তভোগীরা এই অর্থ পাননি। রাশিয়ার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এককালীন টাকা প্রতারণার মাধ্যমে তুলে নিয়েছে চক্রটির সদস্যরা।
ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বনানী থানায় মামলা করেন আহত এক ভুক্তভোগীর স্ত্রী। মামলায় ড্রিম হোম ট্রাভেলসের চেয়ারম্যান এম এম আবুল হাসান ও অংশীদার ফারিহা জেরিন তামান্নাসহ চারজনকে আসামি করা হয়। সিআইডি ইতোমধ্যে তামান্না ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রুশ নাগরিক মুহাম্মদ আলমগীরকে গ্রেপ্তার করেছে। আদালতে দুজনই স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। তদন্তে জানা গেছে, মানবপাচারের এই চক্রে অন্তত ১০ থেকে ১২টি ট্রাভেল এজেন্সি জড়িত, যারা বাংলাদেশ, সৌদি আরব ও রাশিয়ায় সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।
সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ভুক্তভোগীদের অভিযোগ নিয়ে তদন্ত চলছে। অনেকেই দেশে ফিরতে চাইছেন, কিন্তু দুঃখজনকভাবে বেশ কয়েকজন ইতোমধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ হারিয়েছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রাশিয়ায় বৈধভাবে থাকা প্রায় পাঁচ হাজার বাংলাদেশির তথ্য সরকারের কাছে রয়েছে। তবে সৌদি আরব হয়ে রাশিয়ায় যাওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে কোনো পরিসংখ্যান নেই। ভুক্তভোগীরা চাইলে দূতাবাস বা কনস্যুলেটের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, প্রলোভনে পড়ে বাংলাদেশিরা যুদ্ধে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন, আহত হচ্ছেন, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। সরকারের উচিত হবে রাশিয়ায় কতজন বাংলাদেশি যুদ্ধক্ষেত্রে গেছেন, তার একটি পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ তৈরি করা এবং তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া।
বাংলাধারা/এসআর