ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ১ কার্তিক ১৪৩২

দলবাজ ব্যবসায়ীর ছত্রছায়ায় শূন্য মেঘনা নদীর ‘ইলিশ খনি’

নিজস্ব প্রতিবেদক

 প্রকাশিত: অক্টোবর ০৩, ২০২৫, ১২:০৯ দুপুর  

ফাইল ছবি

বরিশালের হিজলা উপজেলার গৌরবদী ইউনিয়ন- একসময় যাকে বলা হতো ‘ইলিশের খনি’। কিন্তু সেই খনি আজ প্রায় ফাঁকা। নদীতে ইলিশের ছড়াছড়ি এখন অতীত স্মৃতি, আর এই বিপর্যয়ের পেছনে রয়েছে দলবাজ ব্যবসায়ীদের অপ্রতিরোধ্য দাপট।

সাড়ে ১৫ বছর ধরে মেঘনার এই অংশ ছিল আওয়ামী লীগ নেতা ও হিজলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নজরুল ইসলাম মিলনের নিয়ন্ত্রণে। ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের পদে থেকে তিনি ইলিশ ব্যবসাকে নিজের আয়-রোজগারের বড় খাতে পরিণত করেন। আইনের তোয়াক্কা না করে চলে জাটকা ও মা ইলিশ নিধন। স্থানীয়দের অভিযোগ, মৎস্য অধিদপ্তরের নিয়মকানুন নয়, মিলনের নির্দেশই ছিল নদীর একমাত্র শাসন।

কিন্তু গত বছরের রাজনৈতিক পালাবদলের পর পরিস্থিতি বদলায়। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের জায়গা দখল করে নিয়েছে বিএনপির স্থানীয় নেতারা। সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক গাফফার তালুকদারসহ কয়েকজন নেতা এখন নদীর বিভিন্ন অংশ নিয়ন্ত্রণ করছেন।

চাঁদপুরের ষাটনল থেকে শুরু করে ভোলার চরফ্যাশন, বরিশালের হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ পর্যন্ত মেঘনার দুই তীরে ছড়িয়ে আছে শত শত মাছঘাট। প্রভাবশালী নেতারাই এসব ঘাটের মালিকানায় ভাগ বসান। জেলেদের লাখ লাখ টাকা অগ্রিম দাদন দিয়ে তারা নিশ্চিত করেন মাছ বিক্রির কমিশন। নিষেধাজ্ঞার মৌসুমেও তাদের মদদে চলে নির্বিচার শিকার।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর মেঘনার ঘাটগুলো দখলে নেয় বিএনপি নেতারা। হিজলা, মেমানিয়া, হরিণাথপুর, ধুলখোলা, মেহেন্দীগঞ্জ- প্রতিটি এলাকায় এখন বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতারা ভাগ করে নিয়েছেন নদী। যুবদল, ছাত্রদল থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাদের হাতে রয়েছে এই ঘাটের নিয়ন্ত্রণ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইলিশ সংকটের মূল কারণ হচ্ছে প্রজনন মৌসুমে নির্বিচারে জাটকা ও রেণু নিধন। কারেন্ট, বেহুন্দি, বাঁধা, খুঁটি- নানা নিষিদ্ধ জালে ধরা পড়ছে লাখ লাখ পোনা। চিংড়ি শিকারের নামে প্রতিদিন ধ্বংস হচ্ছে হাজার হাজার রেণু মাছ।

মৎস্য অধিদপ্তর প্রতিবছর ২২ দিন (আশ্বিন মাসে) নদী-সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেয়। মার্চ-এপ্রিলে আরও দুই মাস থাকে মাছ ধরা বন্ধ। কিন্তু বাস্তবে এসব আইন কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। মাছঘাট নিয়ন্ত্রকরা প্রশাসনকে পাশ কাটিয়ে জেলেদের মাঠে নামান। এমনকি অভিযানে গিয়ে কোস্ট গার্ডকেও ফিরতে হয়েছে হামলার মুখে।

মৎস্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, জাটকা জব্দের পরিমাণ প্রতি বছরই কমছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে যেখানে ১৪৬ টন জাটকা জব্দ হয়েছিল, সেখানে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা নেমে এসেছে মাত্র ৩৭ টনে। অথচ মোকামে শত শত মণ জাটকা বিক্রি হতে দেখা যায়। ২ থেকে ৩ ইঞ্চি সাইজের ইলিশ বাজারে চাপিলা নামে বিক্রি হয়, এক কেজিতে ৪০টিরও বেশি পোনা পাওয়া যায় মাত্র ২০০ টাকায়।

জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন মাতুব্বরের ভাষ্য, “বর্তমান সংকটের জন্য দায়ী মাছ ব্যবসায়ীরাই। তারা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে নির্বিচারে জাটকা নিধন চালিয়ে যাচ্ছে।”

হিজলা বিএনপির আহ্বায়ক গাফফার তালুকদার অবশ্য দায় স্বীকার করেননি। তাঁর দাবি, “আমার এখন মাত্র তিনটি ঘাট আছে। অন্যরা হয়তো জাটকা নিধনে জড়িত, আমি এসব সমর্থন করি না।”

অন্যদিকে মেহেন্দীগঞ্জ গোবিন্দপুর ইউনিয়ন যুবদল সভাপতি মিজান মাঝি বলেন, “মেঘনায় জাটকা পাওয়া যায় না, তাহলে শিকার করব কীভাবে?” তবে তাঁর পরিবারের মালিকানায় সাত থেকে আটটি মাছঘাট আছে বলে তিনি স্বীকার করেছেন।

শ্রমিক দল সভাপতি শাহিন খানও জাটকা নিধনের দায় অস্বীকার করলেও স্বীকার করেন, নির্বিচার শিকারের কারণে মেঘনায় এখন আর ইলিশ নেই।

ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মোল্লা এমদাদুল্লাহ স্পষ্ট করে বলেন, “চাঁদপুরের ষাটনল থেকে বরিশালের হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ পর্যন্ত মেঘনা হলো মা ইলিশের প্রধান প্রজনন ক্ষেত্র। এখানে ইলিশ রক্ষা না হলে কোথাও ইলিশ থাকবে না।”

আগামীকাল শনিবার থেকে শুরু হচ্ছে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা। এ সময় মেঘনা-তেঁতুলিয়ার প্রতিটি পয়েন্টে থাকবে স্পিডবোট, যাতে কেউ নিয়ম ভাঙতে না পারে। তবে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় যদি নির্বিচার শিকার চলতেই থাকে, তবে মেঘনার ‘ইলিশ খনি’ পুরোপুরি শূন্য হয়ে যাওয়াই সময়ের অপেক্ষা।


বাংলাধারা/এসআর