এনবিআরে দুর্নীতির অভিযোগে পদক্ষেপ, বেকায়দায় মধ্যস্থতাকারীরা
প্রকাশিত: জুলাই ০৩, ২০২৫, ১০:৪৪ দুপুর

ছবি: সংগৃহিত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা ও কমিশনারের বিরুদ্ধে একের পর এক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার। বুধবার চার সদস্য ও এক কমিশনারকে অবসরে পাঠানো এবং এক কমিশনারকে বরখাস্তের ঘটনায় চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আরও অন্তত ১১ কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে নেমেছে।
এ অবস্থায় এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে আন্দোলন করে কর্মবিরতি থেকে ফিরলেও কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। কারণ, আন্দোলন প্রত্যাহারের সময় মধ্যস্থতা করা ব্যবসায়ীদের আশ্বাসের পরও সরকার কঠোর অবস্থান নিচ্ছে। এতে বিব্রত সেই ব্যবসায়ী নেতারাও।
বুধবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) থেকে পৃথক চারটি আদেশে অবসরে পাঠানো হয়েছে এনবিআরের কর বিভাগের সদস্য আলমগীর হোসেন, শুল্কনীতি ও আইসিটি বিভাগের সদস্য হোসেন আহমদ, মূসক নীতি বিভাগের সদস্য আবদুর রউফ এবং কমিশনার মো. শব্বির আহমেদকে। শব্বির আহমেদ বরিশাল কর অঞ্চলের কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন।
আদেশে বলা হয়, চারজনের চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। জনস্বার্থে সরকারি চাকরি আইন ২০১৮-এর ৪৫ ধারায় তাদের অবসরে পাঠানো হয়েছে। তারা বিধি অনুযায়ী অবসর সুবিধা পাবেন।
এর একদিন আগে মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার (চলতি দায়িত্ব) জাকির হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। অভিযোগ, ২৮ ও ২৯ জুন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস বন্ধ রাখায় আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছিল, যা রাজস্ব ক্ষতিসহ দেশের বাণিজ্যে বড় ধাক্কা দিয়েছে। বরখাস্তকালীন সময়ে তিনি খোরপোশ ভাতা পাবেন।
ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যস্থতায় আন্দোলন প্রত্যাহারের পরও সরকার এমন ব্যবস্থা নেওয়ায় সবচেয়ে বেশি বিব্রত অবস্থায় পড়েছেন তারাই। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, লাগাতার শাটডাউনের মাধ্যমে এনবিআরের আন্দোলনকারীরা দেশকে জিম্মি করেছিল। যুদ্ধাবস্থা ছাড়া কখনও বন্দর বন্ধ হয় না, কিন্তু এবার হয়েছে। যদিও এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবি অযৌক্তিক ছিল। দেশের স্বার্থে ব্যবসায়ীরা মধ্যস্থতা করেছিলাম। সরকার আশ্বাস দিয়েছিল, কারও চাকরি যাবে না। সেই বিশ্বাসেই কর্মকর্তারা আন্দোলন প্রত্যাহার করেছিলেন। এখন সব উল্টো ঘটছে। আমরাও বিব্রত।
তিনি আরও বলেন, কারও বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে সরকার পরেও ব্যবস্থা নিতে পারত। এভাবে সমঝোতাকারীদের সম্মানও ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন,
“বন্দর বন্ধ করে অর্থনীতিকে জিম্মি করা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু আন্দোলন প্রত্যাহারের পরও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তাতে আমাদেরও মুখ দেখানোর উপায় নেই। সরকারের উচিত কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে দেওয়া হচ্ছে কিনা, তা ভেবে দেখা।”
গত ১২ মে অর্থ মন্ত্রণালয় এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্বনীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগে বিভক্ত করতে অধ্যাদেশ জারি করলে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এর বিরোধিতা শুরু করেন। দাবি ছিল, এনবিআর বিলুপ্তি রোধ এবং চেয়ারম্যানের অপসারণ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আশ্বাসে ২৫ মে প্রথম দফায় আন্দোলন স্থগিত হয়। তবে ২২ জুন থেকে ফের চেয়ারম্যান অপসারণের দাবিতে আন্দোলন জোরালো হয়। ২৮ ও ২৯ জুন কমপ্লিট শাটডাউন ও মার্চ টু এনবিআর কর্মসূচিতে চট্টগ্রামের কাস্টম হাউস বন্ধ হয়ে যায়। ফলে পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম।
পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যবসায়ী নেতারা মধ্যস্থতায় এগিয়ে আসেন। ২৯ জুন রাতে আন্দোলন প্রত্যাহার করে পরদিন কাজে যোগ দেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান সেদিন সবাইকে “সব ভুলে কাজে ফেরার” আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর থেকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে একের পর এক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে, এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদক অনুসন্ধান শুরু করেছে। গত ২৯ জুন প্রথম দফায় এনবিআরের নীতি বিভাগের সদস্য এ কে এম বদিউল আলম, নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার, ঢাকা কর অঞ্চল-৮-এর অতিরিক্ত কমিশনার মির্জা আশিক রানা, ঢাকা কর অঞ্চল-১৬-এর অতিরিক্ত কর কমিশনার মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা, ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের অতিরিক্ত কমিশনার সাধন কুমার কুণ্ডু এবং বিসিএস কর একাডেমির যুগ্ম কর কমিশনার মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দিন খানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।
গত বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দফায় আরও পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের কথা জানিয়েছে সংস্থাটি। তারা হলেন এনবিআরের সদস্য মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন, সদস্য লুতফুল আজীম, বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (ভ্যাট) অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল রশীদ মিয়া, কর অঞ্চল-১৬-এর উপকর কমিশনার মোহাম্মদ শিহাবুল ইসলাম এবং যুগ্ম কমিশনার তারেক হাছান।
সরকারের এই কঠোর অবস্থানে আতঙ্কিত এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী তিন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
“ব্যবসায়ীদের অনুরোধে এবং সরকারের আশ্বাসে আন্দোলন প্রত্যাহার করেছি। অথচ প্রতিশ্রুতি মানা হচ্ছে না। অনেকেই তো বাধ্য হয়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন। এখন তাদের উপর নির্যাতনের খড়্গ নেমে এসেছে। সরকারকে অনুরোধ করছি, এমন কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসুন।”
মোটকথা, এনবিআর সংস্কার আন্দোলনের জের ধরে সরকারের একের পর এক শাস্তিমূলক পদক্ষেপে বেকায়দায় পড়েছেন শুধু কর্মকর্তারাই নয়, আন্দোলন থামাতে মধ্যস্থতাকারী ব্যবসায়ীরাও। এখন সবার নজর সরকারের পরবর্তী সিদ্ধান্তের দিকে।
বাংলাধারা/এসআর