থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্তে ফের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, নিহত অন্তত ১৬
প্রকাশিত: জুলাই ২৬, ২০২৫, ১২:৪০ রাত

ছবি: সংগৃহিত
থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ আবারও নতুন করে প্রাণহানির ঘটনা ঘটিয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) ভোরে শুরু হওয়া সংঘর্ষ শুক্রবার (২৫ জুলাই) পর্যন্ত গড়ায়। থাই কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত তাদের অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। আহত হয়েছেন আরও ৪৬ জন। অন্যদিকে কম্বোডিয়ার স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, থাই হামলায় তাদের একজন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন পাঁচজন।
উল্লেখ্য, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার দীর্ঘ ৮০০ কিলোমিটারের অভিন্ন সীমান্ত অঞ্চল নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে। কিছু বনাঞ্চল ও বিশেষ করে ঐতিহাসিক প্রেয়া ভিহেয়ার মন্দির ঘিরে মালিকানা দাবি করে আসছে উভয় দেশ। এই বিরোধের পেছনে ১৯০৭ সালে ফরাসি উপনিবেশিক আমলে তৈরি করা একটি মানচিত্রকে কেন্দ্র করে বিরোধ আরও জটিল হয়ে ওঠে। ১৯৬২ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) এই মন্দিরের মালিকানা কম্বোডিয়ার বলে রায় দিলেও থাইল্যান্ড তা মেনে নেয়নি। ২০১১ ও ২০১৩ সালে এই অঞ্চল নিয়ে আবারও আইসিজেতে মামলা হয় এবং আদালত কম্বোডিয়ার পক্ষেই রায় দেয়।
সর্বশেষ সংঘর্ষের আগে গত মে মাসেও সীমান্তে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে, যাতে একজন কম্বোডীয় সেনা নিহত হন। এরপর দুই দেশের সেনা কমান্ডারদের মধ্যে বৈঠক হলেও উত্তেজনা পুরোপুরি প্রশমিত হয়নি। এর মধ্যেই গত ১৬ ও ২৩ জুলাই সীমান্তে পুঁতে রাখা ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে চারজন থাই সেনা আহত হন, যাদের একজন তার পা হারান। থাইল্যান্ড এই ঘটনার জন্য সরাসরি কম্বোডিয়াকে দায়ী করলেও কম্বোডিয়া দাবি করেছে, সেনারা নির্ধারিত সীমার বাইরে গিয়ে পুরনো যুদ্ধকালীন বিস্ফোরকে পা দিয়েছিলেন।
সংঘর্ষ শুরুর পর থাইল্যান্ড পুরো সীমান্ত বন্ধ ঘোষণা করে। কেবল শিক্ষার্থী, চিকিৎসাসেবাগ্রহীতা ও জরুরি প্রয়োজনে থাকা ব্যক্তিদের সীমিত চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়। অন্যদিকে কম্বোডিয়া জবাবে থাই চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন সম্প্রচার নিষিদ্ধ করে এবং থাইল্যান্ড থেকে জ্বালানি, গ্যাস, ফলমূল ও সবজি আমদানি বন্ধ করে দেয়। সীমান্তের বিভিন্ন চেকপোস্টও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও মালয়েশিয়া দুই দেশের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিলেও থাইল্যান্ড তা প্রত্যাখ্যান করেছে। থাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নিকোরন্দেজ বালানকুরা শুক্রবার জানান, "আমরা এখনই তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতার প্রয়োজন দেখছি না।"
এদিকে সীমান্ত সংঘর্ষ থাইল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও বড় ধাক্কা দেয়। জুলাইয়ের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রার একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়, যেখানে তিনি কম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী হুন সেনকে ‘চাচা’ বলে সম্বোধন করেন এবং নিজ দেশের সেনাবাহিনী সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। এতে বিরোধীদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। জোট সরকারের শরিক ভুমজাইথাই পার্টি সমর্থন প্রত্যাহার করলে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পেতংতার্নকে সরানো হয়। এরপর ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফুমথাম ওয়েচায়াচাই।
বর্তমানে পরিস্থিতি থমথমে। সীমান্তে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করা হয়েছে এবং দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কও চরম উত্তেজনায় পৌঁছেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সংঘর্ষের মূলে রয়েছে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত ভূখণ্ডগত বিরোধ এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট- যা না কাটলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। তথ্যসূত্র: বিবিসি, এপি।
বাংলাধারা/এসআর