ঢাকা, শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ২ কার্তিক ১৪৩২

মা ইলিশ রক্ষায় ড্রোন নজরদারি, তবু দুশ্চিন্তায় জেলেরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

 প্রকাশিত: অক্টোবর ০৩, ২০২৫, ০২:২৫ দুপুর  

ছবি: সংগৃহিত

বরিশালের হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার মাঝ বরাবর প্রায় ৯০ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত মেঘনা নদী। জেলেদের কাছে এই নদী ‘ইলিশের খনি’ নামে পরিচিত। সেই নদীতেই আজ শুক্রবার (৪ অক্টোবর) মধ্যরাত থেকে শুরু হচ্ছে টানা ২২ দিনের কঠোর নিষেধাজ্ঞা। মা ইলিশ রক্ষায় এবার প্রশাসন ব্যবহার করছে আধুনিক প্রযুক্তি- ড্রোন নজরদারি।

কোস্ট গার্ড, নৌ পুলিশ, র‍্যাব ও সেনাবাহিনীর যৌথ তৎপরতায় নদীতে সার্বক্ষণিক টহল থাকবে। মৎস্য কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, অন্তত চারটি ড্রোন আকাশ থেকে নদীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করবে। যেখানে জাল পড়বে, সেখানেই স্পিডবোট পৌঁছে যাবে।

তবে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। মা ইলিশ রক্ষা অভিযানে একাধিকবার সরকারি কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হামলার শিকার হয়েছেন। পাল্টা প্রতিরোধে জেলের প্রাণও গেছে। ফলে নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হলেও প্রশাসনের ভেতর চাপা ভয় কাজ করছে।

মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ওমর সানি বলেন, “সচেতনতা সভা, স্পিডবোট, মোবাইল কোর্ট সব প্রস্তুত রয়েছে। তবুও অভিজ্ঞতা বলছে, দাদন প্রথা ও মহাজনদের চাপে অনেকে নিষেধাজ্ঞা ভেঙে নদীতে নামবেন। তখনই মুখোমুখি সংঘর্ষের ঝুঁকি তৈরি হয়।”

সরকারি হিসাবে বরিশালে প্রায় ৭৯ হাজার জেলে রয়েছেন। এর মধ্যে ৬৬ হাজার ৫২৪ পরিবার পাচ্ছেন ২৫ কেজি করে চাল। কিন্তু জেলেদের দাবি, এই বরাদ্দে সংসার চলে না। কেউ সময়মতো চাল পান না, আবার কেউ পুরো বরাদ্দ হাতে পান না। ফলে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরতে বাধ্য হন।

মেহেন্দীগঞ্জের উলানিয়ার জেলে আলী হোসেন বলেন, “ছয় সদস্যের সংসারে প্রতিদিন আড়াই কেজি চাল লাগে। সরকারের দেওয়া ২০-২৫ কেজি চাল দিয়ে সংসার চলে না। মাছ ধরতে মানা, সংসার চালাতে দায়।” হিজলার টুমচরের জেলে খালেক বেপারী জানান, “এবার মাছ না পাওয়ায় দাদন শোধ করতে পারিনি। দাদন শোধ না করলে আগামী মৌসুমে আর টাকা পাবো না। তাই অনেকেই নিষেধাজ্ঞার ভেতরেও নদীতে নামছেন।”

জাতীয় মৎস্য শ্রমিক অধিকার ফোরামের যুগ্ম-আহ্বায়ক এস এম জাকির হোসেন বলেন, “ঋণের বোঝা আর ধরা পড়ার ভয়—এই দুই ফাঁদে জেলেরা পড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয় মা ইলিশ ধরতে।”

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিপন কান্তি ঘোষ জানিয়েছেন, মা ইলিশ রক্ষায় জেলা টাস্কফোর্সের সঙ্গে সমন্বয় করে ৩০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে কাজ করবেন। তবে গবেষকরা বলছেন, আইনি পদক্ষেপ ও প্রযুক্তি সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসছে না। ইলিশ সম্পদ রক্ষা ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক মোল্লা এমদাদুল্যাহ বলেন, “গত বছর প্রায় ৪০ হাজার টন ইলিশ কমেছে। এ বছরও উৎপাদন কমার সম্ভাবনা রয়েছে।”

নৌ পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার ইমরান হোসেন মোল্লা বলেন, “ড্রোন নজরদারি চালু থাকবে। কেউ আইন ভাঙলে ছাড় নেই।” তবে জেলেদের প্রশ্ন, “আইন মানলে সংসার চলবে কীভাবে?”

শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও ইলিশ গবেষক মীর মোহাম্মদ আলী মন্তব্য করেন, “ড্রোনে ধরা পড়বে নদীর প্রতিটি নৌকা, কিন্তু ধরা পড়বে কি জেলেদের বুকের হাহাকার? স্পিডবোটে জাল আটকানো যাবে, কিন্তু শিশুর মুখে ভাত পৌঁছাবে কারা?”

বিশেষজ্ঞদের মতে, মা ইলিশ রক্ষা কেবল আইন প্রয়োগ বা প্রযুক্তির বিষয় নয়, বরং জেলেদের জীবিকার নিরাপত্তার সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত। তাদের বিকল্প আয় ও সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়া মা ইলিশ রক্ষার কার্যক্রম পূর্ণ সফলতা পাবে না।


বাংলাধারা/এসআর