ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৬ শ্রাবণ ১৪৩২

দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা

ইসির প্রস্তাবে একমত বিএনপি, সংশোধন চায় টিআইবি

নিজস্ব প্রতিবেদক

 প্রকাশিত: জুলাই ২৬, ২০২৫, ০৭:২২ সকাল  

ফাইল ছবি

জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের জন্য প্রণীত আচরণ বিধিমালার খসড়ায় নির্বাচন কমিশন (ইসি) পেয়েছে মোট ৪৩টি মতামত ও সুপারিশ। এই তালিকায় আছে আটটি রাজনৈতিক দল, দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ৩৩ জন ব্যক্তি। প্রস্তাবগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিএনপি খসড়ার বেশিরভাগ প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনের দাবি জানিয়েছে। অন্যদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আচরণ বিধিমালায় ব্যাপক সংস্কারের প্রস্তাব দিয়ে খসড়ার কিছু ধারা অস্পষ্ট বলেও মন্তব্য করেছে।

গত ২৯ জুন আচরণ বিধিমালার খসড়া ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। এরপর ১০ জুলাই পর্যন্ত মতামত জমা দেওয়ার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়। নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পরও বিএনপি তাদের মতামত জমা দেয়। তবে কমিশন সূত্র বলছে, বিলম্বিত হলেও বিএনপির প্রস্তাবগুলো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হচ্ছে।

বিএনপি তাদের জমা দেওয়া সুপারিশে প্রতিটি ধারা অনুযায়ী মতামত জানায় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একমত পোষণ করে। তবে তারা নির্বাচনকালীন সময়ে দলীয় প্রধানের পাশাপাশি মহাসচিবকে আকাশযান ব্যবহারে অনুমতি দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে বিশেষ ধারা যুক্তের দাবিও জানায় দলটি। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদ্বেষমূলক বা বিকৃত কনটেন্ট প্রচার নিষিদ্ধ করতে বিটিআরসি’র মাধ্যমে মনিটরিংয়ের প্রস্তাব দিয়েছে।

বিএনপি আরও বলেছে, সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি ক্যাম্পের বদলে তিনটি নির্বাচনি ক্যাম্প স্থাপনের সুযোগ দেওয়া উচিত। সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সংজ্ঞায় ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান’-এর সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করার দাবিও জানিয়েছে দলটি।

টিআইবি আচরণ বিধিমালায় বৃহত্তর পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে। সংস্থাটির মতে, খসড়ার অনেক ধারা এখনো অস্পষ্ট ও দুর্বল। তারা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য পৃথক আচরণ বিধিমালা চায়, যাতে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হয়। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে তারা বলছে, বিভিন্ন নির্বাচনে সরকারি কর্মচারীরা নির্দিষ্ট দলের হয়ে কাজ করেছেন, যা প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

টিআইবি প্রস্তাব করেছে, প্রার্থীদের হলফনামা যাচাইয়ের জন্য একটি অটোমেশন সিস্টেম গড়ে তোলা হোক, যাতে আয়, সম্পদ, ঋণ ও ব্যয়ের তথ্য নির্ভরযোগ্যভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। একই সঙ্গে নির্বাচনি অর্থায়নের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আয়-ব্যয়ের হিসাব জনগণের জন্য উন্মুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। দুর্নীতিপরায়ণদের মনোনয়ন না দেওয়া এবং নির্বাচিতদের সম্পদ ও হলফনামা নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশের প্রস্তাবও দিয়েছে সংস্থাটি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কনটেন্ট ব্যবস্থাপনায় নতুন ধারা সংযোজনের প্রস্তাব করেছে টিআইবি। তাদের সুপারিশ অনুযায়ী, এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভুল বা বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট ছড়ালে প্রার্থী ও দলকে দায়ী করার বিধান থাকতে হবে। ফলাফল প্রকাশের আগে অনিয়মের তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন প্রকাশের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি।

বিকল্পধারা বাংলাদেশ প্রচারযন্ত্রে পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। দলটি রেক্সিন বা পিভিসিতে ব্যানার তৈরির অনুমতি চেয়ে বলেছে, বিলবোর্ড ব্যবহারের অনুমতি দিলে বিত্তবান প্রার্থীরা বাড়তি সুবিধা নেবে, এতে ব্যয়ের ভারসাম্য থাকবে না। দলটি আরও বলেছে, ভোটকেন্দ্রের ভেতরে এবং আশপাশে যেন ভোটার ছাড়া কেউ অবস্থান করতে না পারে- সেই বিধান স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।

বিএনপি ও বিকল্পধারার পাশাপাশি যেসব রাজনৈতিক দল মতামত দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ রক্ষণশীল দল, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) এবং সম্মিলিত গণতান্ত্রিক দল। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে টিআইবি ছাড়াও ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইইডি) মতামত দিয়েছে। ৩৩ জন ব্যক্তি যাঁরা মতামত দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক আমলা, প্রবাসী এবং সমাজ বিশ্লেষকরা।

বিএনএফ তাদের প্রস্তাবে সশস্ত্র বাহিনীকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মোতায়েন করে ম্যাজিস্ট্রেসির ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলেছে। তারা ভোটারদের নিরাপদে কেন্দ্রে যাওয়া ও ফেরা নিশ্চিত করার দাবিও জানিয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সব মতামত সংকলন করে তা কমিশনের সভায় উপস্থাপন করা হবে। নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেছেন, "আচরণ বিধিমালার ওপর যেসব মতামত এসেছে, সেগুলো অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। আগামী কমিশন সভায় তা পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।"

তিনি আরও জানান, কমিশন এখন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের কাজও করছে। আরপিও সংশোধনের পর তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আচরণ বিধিমালাও হালনাগাদ করা হবে।

নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করতে আচরণ বিধিমালার চূড়ান্ত রূপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত মতামত, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পর্যবেক্ষণ এবং নাগরিকদের সুপারিশগুলো বিবেচনায় নিয়ে একটি কার্যকর ও সময়োপযোগী আচরণ বিধিমালা প্রণয়ন করতে পারলে, আগামীর নির্বাচন আরও গ্রহণযোগ্য হতে পারে।


বাংলাধারা/এসআর