ঢাকা, শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ২ কার্তিক ১৪৩২

রোহিঙ্গা ঢলের আট বছর : বাড়ছে সংকট, কমছে সহযোগিতা

নিজস্ব প্রতিবেদক

 প্রকাশিত: আগস্ট ২৫, ২০২৫, ১০:২০ দুপুর  

ছবি: সংগৃহিত

বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নেওয়ার আট বছর পেরিয়ে গেলেও সংকট কোনোভাবেই প্রশমিত হয়নি। ২০১৭ সালের আগস্টে প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসেন প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা। তাদের সঙ্গে আগে থেকে অবস্থান করা রোহিঙ্গা এবং ক্রমবর্ধমান জন্মহার যোগ হয়ে এই সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ লাখে। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও প্রত্যাবাসনের কোনো অগ্রগতি হয়নি। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে চুক্তি হলেও আজ পর্যন্ত একজনকেও ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। রাখাইনের সহিংসতা, অস্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে কেউই ফিরে যেতে রাজি নন। জোর করে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আপত্তি রয়েছে।

এই দীর্ঘ সংকটের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও ক্রমশ কমে আসছে। রোহিঙ্গাদের সহায়তায় ২০২৫ সালের জন্য ৯৩ কোটি ৪৫ লাখ মার্কিন ডলার তহবিল চাওয়া হলেও আগস্ট পর্যন্ত পাওয়া গেছে মাত্র ৩৩ কোটি দুই লাখ ডলার, যা প্রয়োজনের মাত্র ৩৫ শতাংশ। অথচ এর আগের কয়েক বছর গড়ে ৬৮ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত সহায়তা পাওয়া যেত। বৈশ্বিক নানা সংঘাত ও দুর্যোগ, বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজা-ইসরায়েল সংঘাত এবং আফ্রিকার রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দাতাদের মনোযোগ অন্যদিকে সরে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের খাদ্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সংকুচিত হয়ে আসছে।

রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগের ইতিহাস বহু পুরোনো। কয়েক দশক ধরে তারা মিয়ানমারে বৈষম্য ও দমননীতির শিকার। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সেনাবাহিনী রাখাইনে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালালে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। জাতিসংঘের তদন্তে তখন কয়েক হাজার রোহিঙ্গা নিহত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু সেই গণহত্যার বিচার আজও হয়নি। বরং ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারে সহিংসতা আরও বেড়েছে। সেনা অভিযানে এখন পর্যন্ত ৩৩ লাখেরও বেশি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত। রাখাইনে রোহিঙ্গারা এখনো নাগরিকত্বহীন অবস্থায় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি, আর স্থানীয় পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণও মূলত আরাকান আর্মির হাতে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও কিছু অগ্রগতি হয়েছে। আর্জেন্টিনার আদালত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংসহ ২৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতও একই বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সামরিক জান্তাকে আন্তর্জাতিক আদালতের সামনে দাঁড় করানোই রোহিঙ্গাদের জন্য সবচেয়ে অর্থবহ সহায়তা হতে পারে।

বাংলাদেশের জন্য পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। তহবিল সংকটের কারণে রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও চিকিৎসায় ঘাটতি দেখা দিচ্ছে, শিশুদের শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে। সংকটের সুযোগে মাদক চোরাচালান, মানবপাচার ও অস্ত্র বাণিজ্যের মতো অপরাধে রোহিঙ্গাদের একাংশ জড়িয়ে পড়ছে। এভাবে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ছে কক্সবাজার ও আশপাশের সমাজ-অর্থনীতিতেও।

বাংলাদেশ সরকার বরাবরই বলে আসছে, এই সংকটের সমাধান কেবল মানবিক নয়, এটি রাজনৈতিকও। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে ফেরত পাঠানোই একমাত্র টেকসই সমাধান। কিন্তু মিয়ানমারে নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব ও সহিংসতা বন্ধের নিশ্চয়তা না থাকায় তা এখনো সম্ভব হয়নি। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার সম্প্রতি বলেছেন, সহিংসতার চক্র ভাঙতে হলে দায়মুক্তির অবসান ঘটাতে হবে এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব ও সমঅধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

আট বছর পর রোহিঙ্গা সংকট আজো অমীমাংসিত। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কমছে, সংকট বাড়ছে, সমাধান অনিশ্চিত থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে যে বোঝা বহন করে চলেছে, তার কোনো স্থায়ী নিরসন এখনো দৃষ্টিগোচর নয়।

বাংলাধারা/এসআর