ঢাকা, শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ১ কার্তিক ১৪৩২

৪০ দিন নগর ভবন বন্ধ, তবু কোটি টাকার তেল খরচ

নিজস্ব প্রতিবেদক

 প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ০৪, ২০২৫, ১১:৪৭ দুপুর  

ছবি: সংগৃহিত

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নগর ভবন টানা ৪০ দিন কার্যত বন্ধ ছিল বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব হস্তান্তরের দাবিতে চলা আন্দোলনের কারণে। এই সময় অধিকাংশ কর্মকর্তা অফিসে আসেননি, সেবা কার্যক্রমও প্রায় বন্ধ ছিল। কিন্তু সরকারি নথিতে দেখা গেছে, প্রতিদিন নিয়মিতভাবে ১৪ থেকে ১৫ লিটার করে তেল খরচ দেখানো হয়েছে।

ডিএসসিসির হিসাব অনুযায়ী, সংস্থাটিতে প্রতি মাসে জ্বালানি খাতে খরচ হয় প্রায় ৫ কোটি টাকা। এপ্রিল, মে ও জুন মাসের ব্যয় পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মে ও জুনে নগর ভবন বন্ধ থাকা সত্ত্বেও জ্বালানি খরচ ছিল স্বাভাবিক সময়ের সমান। বিশ্লেষকদের মতে, এটি শুধু অনিয়ম নয়, সরাসরি দুর্নীতি এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়। করদাতাদের অর্থে পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের কর্মকাণ্ড স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতির নগ্ন বহিঃপ্রকাশ।

গত ২৭ মার্চ আদালত ইশরাক হোসেনকে ডিএসসিসির মেয়র হিসেবে ঘোষণা দেন। নির্বাচন কমিশন ২৭ এপ্রিল গেজেট প্রকাশ করে। এরপর দায়িত্ব হস্তান্তরের দাবিতে বিএনপি নেতাকর্মী ও করপোরেশনের কিছু কর্মচারীর আন্দোলনের কারণে ১৪ মে থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত নগর ভবনের কার্যক্রম বন্ধ থাকে। কিন্তু এই সময়েও কর্মকর্তাদের গাড়িতে নিয়মিতভাবে তেলের হিসাব দেখানো হয়েছে।

পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খায়রুল বাকেরের এসইউভিতে প্রতিদিন ১৫ লিটার তেল খরচ হয়েছে বলে নথিতে উল্লেখ আছে। অর্থাৎ ৪০ দিনে ৬০০ লিটার, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৬১ হাজার টাকা। হিসাব অনুযায়ী গাড়িটি প্রতিদিন গড়ে ১২০ কিলোমিটার চলেছে। কিন্তু নগর ভবন বন্ধ থাকায় এতদূর যাত্রা কোথায় হয়েছে—সে প্রশ্ন থেকেই যায়। একইভাবে প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা মোবাশ্বের হাসানও প্রতিদিন ১৪ লিটার করে ৫৬০ লিটার তেল নিয়েছেন। তার দাবি, নগর ভবন বন্ধ থাকলেও তিনি ওয়াসা ভবন, সচিবালয় ও কর্মচারী হাসপাতালে অফিস করেছেন। তবে করপোরেশনের ভেতরের সূত্র বলছে, আন্দোলনের সময় নিয়মিত অফিস চালানোর মতো কোনো অবকাঠামোই ছিল না, কেবল কিছু জরুরি সভা হয়েছে।

ডিএসসিসির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সংস্থাটিতে মোট ৬১০টি গাড়ি রয়েছে। এর মধ্যে ৯১টি কর্মকর্তাদের, ১০১টি মোটরসাইকেল এবং বাকিগুলো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হয়। এসব গাড়িতে মাসে প্রায় ৫ কোটি টাকা এবং বছরে ৬০ কোটি টাকার বেশি জ্বালানি খরচ হয়। তবে করপোরেশনের অনেক কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, এই খরচের বড় অংশই কাগজে-কলমে। ব্যক্তিগত কাজে সরকারি গাড়ি ব্যবহার, চালকদের খুশি রাখতে অতিরিক্ত তেল বরাদ্দ নেওয়া এবং পরে ওই তেল বিক্রি করার ঘটনা এখানে নিয়মিত। এতে চালক ও জ্বালানি ইস্যুকারী কর্মকর্তা উভয়েই আর্থিকভাবে লাভবান হন।

জুন মাসের হিসাবে দেখা যায়, প্রশাসকের গাড়িতে ৮৫৫ লিটার তেল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বর্তমান প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া একই সঙ্গে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্বে রয়েছেন। ফলে তিনটি গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে তার। এ বিষয়ে তিনি জানান, সব সময় করপোরেশনের গাড়ি ব্যবহার করেন না। তবে তার গাড়ির চালক দাবি করেন, অফিসের কাজেই এ তেল খরচ হয়েছে।

তেল ইস্যুকারী কর্মকর্তা পরিবহন ব্যবস্থাপক আরিফ চৌধুরী বলেন, আন্দোলনের সময় তিনি ব্যস্ত থাকায় আরেকজন তত্ত্বাবধায়ক তেল ইস্যু করেছেন, তবে চূড়ান্ত বিলে তার সই ছিল। অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক মামুন উদ্দিনের দাবি, করপোরেশন বন্ধ থাকলেও অধিকাংশ কর্মকর্তা নিয়মিত অফিস করেছেন।

এ বিষয়ে প্রশাসক শাহজাহান মিয়া বলেন, কেউ যদি অফিস না করেও তেল নিয়ে থাকেন, সেটি সম্পূর্ণ অন্যায়। এমন ঘটনা থাকলে খতিয়ে দেখা হবে।

বাংলাধারা/এসআর