ঢাকা, শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ২ কার্তিক ১৪৩২

বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া হয়ে যুক্তরাজ্য: এশিয়ার কালো টাকার নতুন আশ্রয়ভূমি

নিজস্ব প্রতিবেদক

 প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৫, ১০:৫০ রাত  

ফাইল ছবি

যুক্তরাজ্যের রিয়েল এস্টেট বাজার দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্কিত। এখানে লাল ইটের অট্টালিকা আর ঝকঝকে অফিস ভবনগুলো যেন শুধু স্থাপত্য নয়, বরং অবৈধ অর্থে গড়ে ওঠা দায়মুক্তির প্রতীক। বহু বছর ধরে দুর্নীতি ও অর্থপাচারের টাকায় সম্পদ কেনা হলেও মালিকানা কিংবা অর্থের উৎস নিয়ে খুব কমই প্রশ্ন তোলা হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার দুর্নীতি দমন সংস্থার তদন্তে নতুন করে আলোচনায় এসেছে ব্রিটিশ রাজধানী। প্রশ্ন উঠছে- কীভাবে লন্ডন ক্লেপ্টোক্রাটদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হলো?

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, মালয়েশিয়ার দুর্নীতি দমন কমিশনের (এমএসিসি) অনুসন্ধান যুক্তরাজ্যের সম্পত্তি বাজারকে নতুনভাবে আলোচনায় এনেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের লন্ডনের সম্পত্তির উৎস নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। যদিও মাহাথির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন, তবুও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী প্রয়াত দাইম জায়নুদ্দিনের প্রায় ১৮ কোটি ডলারের সম্পত্তি ফ্রিজ করে দিয়েছে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে রয়েছে লন্ডন সিটি এলাকার বাণিজ্যিক ভবন, মেরিলেবোন ও বেইজওয়াটারের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ঘটনা নতুন কিছু নয়। বছরের পর বছর শেল কোম্পানি, অফশোর কাঠামো এবং ট্যাক্স হেভেনের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ বৈধ সম্পদের সঙ্গে মিশে গেছে। যুক্তরাজ্যের ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জসহ এ ধরনের অঞ্চলগুলো করের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত, যেখানে গোপনীয়তার আড়ালে অর্থ পাচারের সুযোগ অব্যাহত রয়েছে।

মালয়েশিয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের অবৈধ অর্থও যুক্তরাজ্যের রিয়েল এস্টেট খাতে জায়গা করে নিয়েছে। গত মে মাসে ব্রিটিশ ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) প্রায় ৯ কোটি পাউন্ড মূল্যের সন্দেহজনক সম্পত্তি জব্দ করে, যেগুলো বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত নেত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের সঙ্গে যুক্ত বলে ধারণা করা হয়। পরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের তদন্তে সামনে আসে আরও প্রায় ৪০ কোটি পাউন্ড মূল্যের সম্পত্তির তথ্য। এর মধ্যে ছিল লন্ডনের মে ফেয়ার ম্যানশন, সারে কাউন্টির বিলাসবহুল এস্টেট এবং মার্সিসাইডের একাধিক ফ্ল্যাট।

এই কেলেঙ্কারির প্রভাব পড়ে যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতেও। শেখ হাসিনার ভাতিজি টিউলিপ সিদ্দিককে শেষ পর্যন্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল সরাসরি মন্তব্য করেছে—বছরের পর বছর ধরে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ অলিগার্ক ও স্বৈরশাসকদের জন্য লাল গালিচা বিছিয়ে রেখেছে, যাতে তারা অবৈধ সম্পদ নিয়ে এ দেশে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারে।

এশিয়ার আরও দেশ থেকে অবৈধ অর্থ লন্ডনে প্রবাহিত হয়েছে। যেমন—সিঙ্গাপুরে ২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মানি লন্ডারিং মামলায় অভিযুক্তরা অফশোর কোম্পানির আড়ালে লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রিটে ৫৬ মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি কিনেছিলেন। একইভাবে ওয়ানএমডিবি কেলেঙ্কারির অর্থেও যুক্তরাজ্যে প্রায় ৩৪ কোটি ডলারের সম্পদ কেনা হয়।

তবুও যুক্তরাজ্যের প্রতিক্রিয়া তুলনামূলক ধীর। ক্যারিবীয় অঞ্চলের করস্বর্গগুলো এখনও মানি লন্ডারিং চক্রের অন্যতম কেন্দ্র। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য বলছে, গত ৩০ বছরে এসব অঞ্চলের মাধ্যমে ৭৯টি দেশ থেকে প্রায় ২৫০ বিলিয়ন পাউন্ড অবৈধ অর্থ পাচার হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের রিয়েল এস্টেট খাত এখন বৈশ্বিক কালো টাকার গন্তব্য হিসেবে কুখ্যাত। মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ কিংবা সিঙ্গাপুর- যেখান থেকেই আসুক, অর্থ পাচারের প্রবাহ ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে না পারলে লন্ডনের আর্থিক সুনাম আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

 

বাংলাধারা/এসআর