ঢাকা, শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ২ কার্তিক ১৪৩২

ধর্ষণে জড়ালেও শাস্তি হবে না মনে করে ২৭.৫৮% আসামি

নিজস্ব প্রতিবেদক

 প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২৫, ১০:২৪ দুপুর  

ছবি: সংগৃহিত

বাংলাদেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলেও অনেক অভিযুক্তের ধারণা, তারা পার পেয়ে যাবে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, আলোচিত ধর্ষণ মামলার প্রায় ২৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ আসামি মনে করে তাদের কোনো শাস্তি হবে না।

২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন থানা ও আদালতে দায়ের করা ১১ হাজার ৬২৮টি ধর্ষণ মামলা বিশ্লেষণ করেছে পিবিআই। এর মধ্যে ২৫২টি মামলার তদন্ত এখনো চলছে। গবেষণার অংশ হিসেবে তারা আলোচিত ৮৪টি মামলার ৮৭ জন অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তাদের কাছে ৩১টি প্রশ্ন রাখা হয়। সেখানে উঠে আসে, অনেক আসামির পূর্বে থেকেই মাদক ও পর্নোগ্রাফির প্রতি আসক্তি ছিল। কেউ প্রেম বা বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে অপরাধে জড়িয়েছে। ভুক্তভোগীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশই শিশু ও ছাত্রী। অনেক ঘটনায় অপরাধী ছিল ভুক্তভোগীর আত্মীয় বা পরিচিতজন, আর ভুক্তভোগীরা ছিলেন অতিদরিদ্র পরিবার থেকে আসা।

পিবিআই একইসঙ্গে ২০১৮ সালে বিচারিক আদালতে দেওয়া ১০৪টি রায়ও বিশ্লেষণ করেছে। দেখা গেছে, মাত্র ১২টি মামলায় দণ্ড হয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটিতে মৃত্যুদণ্ড। অন্যদিকে ৯২টি মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছে। অর্থাৎ শাস্তির হার দাঁড়িয়েছে মাত্র ১১ দশমিক ৫৪ শতাংশ, আর খালাসের হার ৮৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এ কারণে অভিযুক্তদের মধ্যে শাস্তিহীনতার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে।

গবেষণায় জানা যায়, ৮৭ আসামির মধ্যে ১৫ জন জানতো ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। ৩৭ জন এ বিষয়ে কোনো ধারণাই রাখতো না। আর ৩৫ জন কোনো উত্তর দেয়নি। তবে ২৪ জন স্পষ্টভাবেই বলেছে, তাদের বিশ্বাস ছিল শাস্তি হবে না।

ধর্ষণ মামলার তদন্তে নানা সীমাবদ্ধতার বিষয়ও উঠে এসেছে। এজাহারে অনেক সময় অসম্পূর্ণ বা ত্রুটিপূর্ণ তথ্য দেওয়া হয়। সঠিকভাবে আলামত সংরক্ষণ না করার কারণে প্রমাণ দুর্বল হয়ে যায়। ফরেনসিক ল্যাব ও প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধার ঘাটতিও বড় অন্তরায়। অনেক ঘটনায় ভুক্তভোগীই একমাত্র সাক্ষী, ফলে আদালতে প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আবার সামাজিক রীতিনীতি ও পারিপার্শ্বিক চাপে ভুক্তভোগী সঠিকভাবে ঘটনা বলতে চান না। এতে তদন্ত প্রতিবেদন অস্পষ্ট হয়ে যায় এবং আসামিপক্ষ তার পূর্ণ সুবিধা নেয়।

একইসঙ্গে ভুক্তভোগীদের মানসিক অবস্থা গুরুতরভাবে নাজুক হয়ে পড়ে। অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন, কেউ কেউ মারা যান। আদালতে জেরা চলাকালে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা ভুক্তভোগীকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন। ভুক্তভোগী যদি শুধু বলেন, “অভিযুক্ত ব্যক্তি আমার সঙ্গে খারাপ কাজ করেছে”—এর অন্তর্নিহিত অর্থ যত গুরুতরই হোক, আসামিপক্ষ সেটিকে দুর্বল প্রমাণে রূপান্তর করতে সক্ষম হয়। আইনি সচেতনতার অভাবও বাদী পক্ষের জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

পিবিআই তাদের গবেষণায় কয়েকটি বাস্তব উদাহরণও উল্লেখ করেছে। ২০১৯ সালে ঢাকার ওয়ারীতে সাত বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। তদন্তে জানা যায়, অভিযুক্ত ছিলেন একই ভবনের বাসিন্দা ও পেশায় রংমিস্ত্রি। শিশুটি তাকে চিনত, সেই সুযোগেই তিনি অপরাধটি করেন। আবার ২০১৭ সালে চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে ডাকাতির সময় এক পরিবারের চার নারী সদস্যকে ধর্ষণ করে ডাকাতচক্র। পরে তদন্তে অপরাধ প্রমাণিত হয় এবং কয়েকজন আদালতে স্বীকারোক্তিও দেয়। তবে আবার অনেক মামলায় ভুক্তভোগীরা আদালতে সাক্ষ্য বদলে ফেলেন। যেমন বাহুবল থানার একটি মামলায় ভুক্তভোগী আদালতে বলেন, ভুল বোঝাবুঝি থেকে মামলা হয়েছিল, আসামির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। এমন ঘটনা আসামিদের খালাস পেতে সহায়তা করে।

গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, সাক্ষী হাজির করতে না পারা এবং তদন্তের দুর্বলতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আসামিদের খালাস পেতে সুযোগ করে দেয়। এ কারণে পিবিআই তদন্ত কর্মকর্তাদের জন্য ১৬টি সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ঘটনার খবর পাওয়া মাত্রই ক্রাইমসিন টিমকে অবহিত করা, প্রশিক্ষিত নারী কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে পাঠানো, ভিডিও ধারণ ও ডিএনএ পরীক্ষার আলামত সংগ্রহ, নিখুঁত জব্দ তালিকা প্রস্তুত করা, সাক্ষীদের মোবাইল নম্বর চার্জশিটে যুক্ত করা, এবং সাক্ষী হাজির নিশ্চিত করতে পুলিশের আরও জবাবদিহি তৈরি করা। পাশাপাশি সাক্ষীদের যাতায়াত ও খাবারের ব্যয় সরকারিভাবে বহনের ব্যবস্থাও রাখতে বলা হয়েছে, যাতে তারা আদালতে সাক্ষ্য দিতে উৎসাহিত হন।

পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোস্তফা কামাল বলেন, কেবল কঠোর শাস্তি দিয়ে এ ধরনের অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব নয়। মূল্যবোধ ও নৈতিকতা জাগ্রত করতে হবে। সমাজে এই বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা দরকার, নাহলে শুধু মামলা ও বিচারের মধ্যেই বিষয়টি আটকে থাকবে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম মনে করেন, ধর্ষকদের অনেকের প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকে, তারা সুরক্ষা পায়। অন্যদিকে ভুক্তভোগীরা থাকেন ভীত-সন্ত্রস্ত ও অসহায়। বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে আসামিরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।

সব মিলিয়ে পিবিআইর গবেষণা একটি উদ্বেগজনক বাস্তবতা সামনে এনেছে। ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধে দণ্ডের হার আশঙ্কাজনকভাবে কম। এতে শাস্তিহীনতার সংস্কৃতি আসামিদের মনে গভীরভাবে প্রোথিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু আইনি পদক্ষেপ নয়, সামাজিক সচেতনতা ও মূল্যবোধের পরিবর্তন ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

বাংলাধারা/এসআর