ঢাকা, শনিবার, ২৪ মে ২০২৫, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানোর বদলে বিকল্প খোঁজায় ব্যস্ত সরকার: আনু মুহাম্মদ

নিজস্ব প্রতিবেদক

 প্রকাশিত: মে ২৩, ২০২৫, ১১:৫২ রাত  

ছবি: বাংলাধারা

জাতীয় সক্ষমতা না বাড়িয়ে বিদেশ নির্ভর বিকল্প খোঁজার প্রবণতা সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীনতারই প্রতিচ্ছবি-এমন মন্তব্য করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ড. আনু মুহাম্মদ।

শুক্রবার (২৩ মে) জাতীয় প্রেস ক্লাবের মাওলানা আকরাম খাঁ হলে ‘গণতান্ত্রিক নাগরিক কমিটি’ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেন, “বর্তমান সরকারের মূল দায়িত্ব হওয়া উচিত বৈষম্যহীন একটি বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানো। কিন্তু সরকার সে পথে হাঁটছে না। তারা বিদেশি কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়ে সমস্যার সাময়িক সমাধান খুঁজছে- যেটা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়।”

সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আনু মুহাম্মদ বলেন, “এই সরকার অস্থায়ী, তাদের দীর্ঘমেয়াদি কোনো ম্যান্ডেট নেই। তবে তাই বলে দায়িত্বশীলতা থেকেও তারা অব্যাহতি পেতে পারে না। শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা জোরদারসহ কিছু জরুরি পদক্ষেপ অস্থায়ী সরকারের পক্ষেও গ্রহণযোগ্য ও প্রয়োজনীয়।”

চলমান অর্থবছরের কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “জুলাই থেকে জুন- এই ব্রিটিশ আমলের অর্থবছর দুর্নীতি ও অপচয়ের সুযোগ তৈরি করে। বরং বাংলা সনের ভিত্তিতে ১৪ এপ্রিল থেকে ১৩ এপ্রিল, অথবা ইংরেজি বছরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর অর্থবছর নির্ধারণ করলে কার্যকারিতা বাড়বে।”

তিনি আরও বলেন, “আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, জ্বালানি সবখাতে অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি ও অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফরের নামে টাকা অপচয় হয়। এসব বন্ধ করে বাস্তববাদী ও জনমুখী বাজেট প্রণয়ন করতে হবে।”

আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর বাজেট নিয়ে বিশ্লেষণ করেন সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞরা। তারা বাজেট পরিকল্পনায় নীতি পরিবর্তন ও কাঠামোগত সংস্কারের ওপর জোর দেন।

কৃষি বাজেট নিয়ে আলোচনায় গবেষক মাহা মির্জা বলেন, “উপকরণের দাম বাড়ার কারণে কৃষকের উৎপাদন ব্যয় দিন দিন বাড়ছে। ফসল বিক্রি করেও তারা টিকে থাকতে পারছে না। বিএডিসির বীজ সরবরাহ বাড়ানো এবং কৃষিভিত্তিক অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোশাহিদা সুলতানা ঋতু বলেন, “বিদায়ী সরকার গ্যাস আমদানিতে মোটা অঙ্কের বাজেট বরাদ্দ দিয়েছে, অথচ দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে অবহেলা করেছে। নতুন সরকারকে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে জ্বালানি পরিকল্পনা সাজাতে হবে।”

স্বাস্থ্যখাতের করুণ চিত্র তুলে ধরে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যাপক ডা. হারুন উর রশীদ বলেন, “স্বাস্থ্যকে মৌলিক অধিকার হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। জনমুখী স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে গঠনমূলক পদক্ষেপ জরুরি।”

তিনি চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে ১৬টি করণীয় প্রস্তাব করেন।

গবেষক কল্লোল মোস্তফা বলেন, “বাংলাদেশের কর ব্যবস্থাই বৈষম্যমূলক। সরকার ধনীদের কাছ থেকে কর আদায়ে তেমন উদ্যোগী নয়, কিন্তু মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের ওপর পরোক্ষ করের বোঝা চাপিয়ে দেয়। এটি অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দেয়।”

সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি সালমান সিদ্দিক বলেন, “জাতীয় বাজেটে জিডিপির অন্তত ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ থাকা উচিত। পাশাপাশি শিক্ষকদের সংকট, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নেও নির্দিষ্ট বরাদ্দ প্রয়োজন।”

চলচ্চিত্র নির্মাতা সজীব তানভীর বলেন, “সংস্কৃতি খাতকে অলাভজনক হিসেবে বিবেচনা করার মানসিকতা পরিহার করতে হবে। প্রশাসননির্ভর শিল্পচর্চার ব্যয় কমিয়ে সহজলভ্য সাংস্কৃতিক চর্চায় বরাদ্দ বাড়ানো দরকার।”

লেখক কৌশিক আহমেদ বলেন, “শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদেরও একটি নীতিনিষ্ঠ, জনঅংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে, যেখানে থাকবে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার, পরিবেশ সচেতনতা ও লিঙ্গ সমতার নিশ্চয়তা।”

অ্যাকটিভিস্ট মারজিয়া প্রভা বলেন, “নারী-সুবিধাভোগীদের প্রকল্পে কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে, তা স্পষ্টভাবে দেখাতে হবে। শুধু নারী সংক্রান্ত প্রকল্প থাকলেই তা জেন্ডার বাজেট হয় না।”

আলোচনায় অংশগ্রহণকারী সকলেই একমত হন যে, দেশের আগামী বাজেট হতে হবে জনমুখী, স্বচ্ছ এবং বৈষম্যহীন। অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ ও অন্যান্য বক্তাদের মতামত বাজেট প্রণয়নকারীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা- দেশীয় সক্ষমতা, ন্যায়ভিত্তিক করনীতি ও সার্বজনীন সেবা নিশ্চিতে বাজেট যেন হয়ে ওঠে একটি রূপান্তরের নথি।

 

বাংলাধারা/এসআর