বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যে সংকট: দ্বিপাক্ষিক আস্থায় চিড় ধরার শঙ্কা
প্রকাশিত: মে ১৯, ২০২৫, ০৬:০৩ সকাল

ফাইল ছবি
বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যে নতুন করে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ভারতের হঠাৎ করে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও বেশ কিছু খাদ্যপণ্য স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তে উদ্বেগ বেড়েছে দুই দেশের ব্যবসায়ী ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে। এই নিষেধাজ্ঞাকে অর্থনীতিবিদরা ‘অশুল্ক বাধা’ হিসেবে দেখছেন এবং বলছেন, এ সিদ্ধান্ত শুধু বাণিজ্যে নয়, পারস্পরিক আস্থা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকেও হুমকির মুখে ফেলছে।
গত শনিবার ভারত সব স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি নিষিদ্ধ করে। শুধু তাই নয়, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, পানীয়, প্লাস্টিক সামগ্রী, ফার্নিচারসহ বেশ কিছু পণ্যও স্থলপথে ঢোকার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনে। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের চ্যাংড়াবান্ধা ও ফুলবাড়িয়া শুল্ক স্টেশন দিয়েও এসব পণ্য আর প্রবেশ করতে পারছে না।
এই সিদ্ধান্ত কার্যকরের পরপরই দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দরে আটকে যায় রপ্তানিমুখী পণ্যবাহী ট্রাক। উদাহরণস্বরূপ, বুড়িমারী স্থলবন্দরে প্রাণ গ্রুপের ১৭টি ট্রাক—যার পণ্যের মূল্য প্রায় এক কোটি টাকা—পশ্চিমবঙ্গ ও মেঘালয়গামী ছিল, কিন্তু তা আটকে পড়ে।
প্রাণ গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, “আমরা হঠাৎ করেই জানতে পারি ভারতের এই নিষেধাজ্ঞার কথা। এখন পণ্যগুলো ফেরত আনা ছাড়া উপায় নেই। তবে এটি শুধু আমাদের সমস্যা নয়—এটি দেশের রপ্তানি বাজারের সংকট।”
বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারত থেকে আমদানি করেছে প্রায় ৯০০ কোটি ডলারের পণ্য, অথচ রপ্তানি করতে পেরেছে মাত্র ১৫৭ কোটি ডলারের পণ্য। অর্থাৎ, বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৪৩ কোটি ডলার।
বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য—তৈরি পোশাক, কৃষিজ প্রক্রিয়াজাত পণ্য, প্লাস্টিক সামগ্রী ও আসবাবপত্র—সবচেয়ে বেশি পাঠানো হয় স্থলবন্দর দিয়ে। এখন এসব পণ্যের রপ্তানিতে বাধা আসায় ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে এ খাতগুলো।
দেশের ২৪টি স্থলবন্দরের মধ্যে ১৬টি দিয়ে ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চলে। তবে যাতায়াত সুবিধা ও অবকাঠামোগত কারণে বেনাপোল-পেট্রাপোল রুটেই ৮০ শতাংশের বেশি বাণিজ্য হয়ে থাকে।
গতকাল বেনাপোলে ভারতে ঢোকার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল ৩৬টি তৈরি পোশাকবোঝাই ট্রাক। ভারতের পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী বলেন, "যেসব পণ্যের এলসি বা টিটি হয়েছে, সেগুলোর আমদানির বিষয়ে কাস্টমসে আলোচনা চলছে।"
এদিকে, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর থেকে পিভিসি ডোরের একটি গাড়ি ভারতে না ঢুকে ফেরত এসেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরেও একই চিত্র—বহু পণ্য আটকে গেছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা উদ্বেগে রয়েছেন এবং দ্রুত সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন।
বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত ও বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও পারস্পরিক অর্থনৈতিক নির্ভরতা—বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর বাজার—বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেই বাজারে হঠাৎ প্রবেশাধিকার সীমিত করা হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দুই দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারাও।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, “এ ধরনের অশুল্ক বাধা শুধু বাণিজ্যে নয়, দুই দেশের মধ্যকার আস্থার পরিবেশ ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকেও নষ্ট করতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “সীমান্তবর্তী অঞ্চলের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। আবার একইভাবে, ভারত থেকে বাংলাদেশে আসা কাঁচামাল বিশেষ করে সুতা আমদানিতে যদি বাধা আসে, তাহলে আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, “ভারতের হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তে আমরা বিস্মিত। তবে দু-একদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেই পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করব।”
তিনি বলেন, “দুই দেশের ব্যবসা পরস্পর নির্ভরশীল। ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, প্লাস্টিক ও খাদ্যপণ্যের চাহিদা রয়েছে। সেখানে প্রবেশাধিকার রুদ্ধ হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে উভয় পক্ষই। এমন সিদ্ধান্ত নিলে ব্যবসায়িক পরিবেশের স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হয়।”
এই পরিস্থিতি কেবল বাণিজ্যঘাটতি বা পণ্য আটকে পড়ার বিষয় নয়। এটি দুই দেশের দীর্ঘদিনের কৌশলগত অংশীদারিত্ব ও পারস্পরিক আস্থার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। প্রয়োজন দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান। অহেতুক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে, পারস্পরিক স্বার্থ সংরক্ষণ করে একটি স্থিতিশীল বাণিজ্য পরিবেশ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।
বাংলাধারা/এসআর