ভরা মৌসুমেও চড়ছে চালের দাম, হতাশ কৃষক-ভোক্তা
প্রকাশিত: জুলাই ০৫, ২০২৫, ১০:২৯ দুপুর

ছবি: সংগৃহিত
ভরা মৌসুমে চালের দাম কমার কথা থাকলেও উল্টো ঊর্ধ্বমুখী দেশের বাজার। রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় গত এক সপ্তাহে কেজিপ্রতি ৪ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে চালের দাম। এতে যেমন বিপাকে পড়েছেন সাধারণ ভোক্তা, তেমনি হতাশ কৃষকরাও।
কৃষকরা বলছেন, ধান বিক্রি করে তারা এখন আফসোস করছেন। কারণ, বাজারে চালের দাম লাফিয়ে বেড়েছে। আবার বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এ পরিস্থিতির পেছনে আছে করপোরেট মজুতদারি আর বাজার সিন্ডিকেটের হাত।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট চালের ৫৫ শতাংশই আসে বোরো মৌসুমে। এ বছর বোরোতে রেকর্ড ২ কোটি ১৪ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে। কৃষি উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, গত বছরের চেয়ে এ বছর বোরো উৎপাদন ১৫ লাখ টন বেশি।
তবুও রাজধানীর বাজারে সরু মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে কেজি ৭৫ থেকে ৮৫ টাকায়। মাঝারি মানের (বিআর-২৮) চালের দাম ৫৮ থেকে ৬৩ টাকা, আর মোটা চালের কেজি ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা। ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, এক সপ্তাহের ব্যবধানে সরু ও মোটা চালের কেজি-দর বেড়েছে ৫ টাকা পর্যন্ত, আর মাঝারি চালের দাম বেড়েছে ৪ টাকা।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবেও এক মাসে সরু চালের দাম বেড়েছে ৫ শতাংশ, মাঝারি ও মোটা চালের দর বেড়েছে ৯ শতাংশের বেশি। এক বছরের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে গড়ে ১৫ শতাংশ।
অথচ খাদ্য মজুত আগের চেয়ে বেশি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন গুদামে এখন খাদ্য মজুত আছে ১৭ লাখ ৬৮ হাজার টন, যার মধ্যে চালই ১৩ লাখ ৮২ হাজার টন। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এই মজুত প্রায় ৩ লাখ টন বেশি।
নোয়াখালীর সুবর্ণচরের কৃষক আব্দুর রব বলেন, ধান বিক্রি করে এখন আফসোস করি। এক মাস আগে মণ ১০০০-১১০০ টাকায় বিক্রি করলাম। এখন দেখি, চালে কেজিতে ৮ টাকা বেড়েছে। আমরা ধান থেকে কেজিপ্রতি এক-দেড় টাকা বেশি পেলাম, আর মিলাররা চালে ৮ টাকা লাভ করল!
ময়মনসিংহের ফুলপুরের কৃষক জহর আলীও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যে ভাত আমরা ফলাই, সেই ধান সস্তায় বেইচা এখন আবার চড়া দামে কিনি খাই। আমাদের দেখার কেউ নাই?
রংপুর কৃষক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক পলাশ কান্তি নাগ বলেন, মাঠে যখন ফসল থাকে, তখন দাম কম। কৃষক বিক্রি করার পরই দাম বাড়ানোর খেলা শুরু হয়।”
নওগাঁ চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেনের মতে, বৃষ্টির কারণে ধানের গুণগত মান কিছুটা নষ্ট হয়েছে, ফলে দাম বেড়েছে। তবে বাজার বিশ্লেষকরা একে শুধুই প্রাকৃতিক কারণ বলছেন না। তাদের দাবি, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ঈদের আগেই কৃষকের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে মজুত করেছে। পরে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ চালকল মালিক সমিতির প্রচার সম্পাদক জয়নাল আবেদিন বলেন, ৮৫ শতাংশ মিলারের সংরক্ষণ ক্ষমতা নেই। বড় করপোরেট চালকলগুলো তিন-চার মাসের ধান মজুত করে। তারাই বাজারে সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ায়।
অবস্থা সামাল দিতে সরকার অভিযান শুরু করেছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও জেলা খাদ্য বিভাগ চালের বাজারে অভিযান চালাচ্ছে। তবে পাইকাররা বলছেন, এই অভিযান শুধু খুচরা পর্যায়ে সীমাবদ্ধ। মিলগেট আর গুদাম পর্যায়ে নজরদারি দুর্বল।
চট্টগ্রাম রাইস মিল মালিক সমিতির সভাপতি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, পরিবহনের ভাড়া আর ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় চালের বাজারে প্রভাব পড়েছে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো চাষিদের অগ্রিম টাকা দিয়ে ধান কিনে নিচ্ছে। এতে মিল মালিকরা ধান পাচ্ছেন না।
কুষ্টিয়ার খাজানগর মোকামে মিলগেটে দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও। সরু চালের ২৫ কেজির বস্তা এখন বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮২০ থেকে ১ হাজার ৯২০ টাকায়, যা ঈদের আগে ছিল ১ হাজার ৬৮০ থেকে ১ হাজার ৭২০ টাকা।
মিলারদের একাংশ মনে করেন, ধানের দামের সামান্য বৃদ্ধিতে চালের দর ১-২ টাকা বাড়তে পারে। তবে ৭ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়া অযৌক্তিক। খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা চালের দাম বৃদ্ধিকে মিলারদের কারসাজি বলেই মনে করছেন।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, সব সময় কৃষকের হাতে ফসল থাকতে দাম কমিয়ে রাখা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষক। আবার ফসল কৃষকের হাত থেকে চলে গেলে দাম বাড়িয়ে ভোক্তাকে ক্ষতির মুখে ফেলা হয়। সরকার এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম মাসুদ বলেন, ভরা মৌসুমেও চালের দাম বেড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক। এতে নিম্নবিত্তের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়েছে। কৃষি সংস্কার কমিশন গঠনসহ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
কৃষি উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, সরকার দাম নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। কৃষকের ফসল মধ্যস্বত্বভোগীদের হাত থেকে বাঁচাতে কৃষকের কাছ থেকে ফসল কেনার নির্ধারিত সময় ১৫ দিন এগিয়ে আনা হয়েছে। তবে আমাদের সমস্যা হচ্ছে দুর্নীতি। এটা রোধ করা গেলে সমস্যার সমাধান সম্ভব।
কৃষক আর ভোক্তা- দুই-ই এখন চালের বাজারের দামের খেলায় ক্ষতিগ্রস্ত। সরকার বলছে, অভিযান ও পদক্ষেপ চলছে। তবে বাজারে তার খুব একটা প্রভাব এখনও দেখা যাচ্ছে না।
বাংলাধারা/এসআর