তত্ত্বাবধায়ক সরকারে একমত, গঠন প্রক্রিয়ায় মতপার্থক্য
প্রকাশিত: জুলাই ০৩, ২০২৫, ০৮:৫৮ সকাল

ফাইল ছবি
নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে একমত হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। তবে কেমনভাবে এ সরকার গঠিত হবে- তা নিয়ে মতভেদ রয়ে গেছে। বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের (ন্যাশনাল কনসেন্সাস কমিশন) অষ্টম দিনের সংলাপে এ মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বিএনপি চাইছে, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর অধীনে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ফিরিয়ে আনার বিধান পুনর্বহাল করতে। তবে তারা জানিয়েছে, বিচার বিভাগকে এই প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখতে কোনো বিকল্প প্রস্তাব এলে সেটিও তারা বিবেচনা করবে। বিএনপির নিজস্ব প্রস্তাবনাও রয়েছে, যা এখনো প্রকাশ করা হয়নি।
জামায়াতে ইসলামীও প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতিকে দেখতে চায়। তবে ২০০৬ সালের অভিজ্ঞতার কারণে রাষ্ট্রপতিকে এই দায়িত্বে দেখতে নারাজ দলটি। জামায়াত আরও চায়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হোক।
অন্যদিকে, এনসিপি (ন্যাশনাল কনসেন্সাস পার্টি) নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের ভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছে। তাদের প্রস্তাব, সংসদের নিম্নকক্ষে সরকারি ও বিরোধী দলগুলোর সমন্বয়ে ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাবিত নামের মধ্য থেকে কমিটির অন্তত ৮ জনের সমর্থন পাওয়া ব্যক্তিই হবেন প্রধান উপদেষ্টা। তা সম্ভব না হলে উচ্চকক্ষ “র্যাঙ্কড চয়েজ” পদ্ধতিতে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন করবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ কত হবে, তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ১২০ দিনের প্রস্তাব দিলেও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, ৯০ দিনের মেয়াদেই বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল একমত। তবে অনিবার্য কারণে নির্বাচন পিছোলে অতিরিক্ত ৩০ দিন রাখা যেতে পারে।
সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলো সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে সাংবিধানিক বিশেষায়িত কমিটি গঠনের বিষয়েও একমত হয়েছে। বিএনপি প্রথমে স্বাধীন কমিশন চাইলেও শেষ পর্যন্ত ঐকমত্যের স্বার্থে কমিটি গঠনের প্রস্তাবে রাজি হয়েছে। জামায়াত ও এনসিপিসহ অন্য দলগুলোও এতে একমত।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, সংবিধানের ১১৯(১) অনুচ্ছেদের ‘ঘ’ ধারার শেষে আইন সংযোজনের মাধ্যমে এ কমিটি গঠন করা হবে। এছাড়া সীমানা নির্ধারণ আইন ২০২৫ সালের সংশোধনীর সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনার কথাও বলেন তিনি।
১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকার সংবিধানে ৫৮(ক) অনুচ্ছেদ সংযোজন করে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার বিধান আনে।
তবে ২০১০ সালে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ এই ব্যবস্থা বাতিল করে। আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছিল, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করতে সাময়িকভাবে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা চালু রাখা যেতে পারে, তবে বিচার বিভাগকে এ প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখতে হবে। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে।
এরপর হাইকোর্ট গত বছরের ডিসেম্বরে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন। ত্রয়োদশ সংশোধনী পুনর্বহালের জন্য আপিল বিভাগে রিভিউ করেছে বিএনপি ও জামায়াত। সালাহউদ্দিন আহমেদ আশা প্রকাশ করেছেন, রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরবে।
২০০৬ সালে সর্বশেষ প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে বিএনপিপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত করে তার নিয়োগের বিরোধিতা করেছিল আওয়ামী লীগ। কে এম হাসান দায়িত্ব না নেওয়ায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেই প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন।
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, সাবেক প্রধান বিচারপতিদের মধ্য থেকে গ্রহণযোগ্য কাউকে প্রধান উপদেষ্টা করা সম্ভব না হলে, সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে রাষ্ট্রপতি এ দায়িত্ব দেবেন। তবে রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রাখার বিষয়ে দলটি অনাগ্রহী।
বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, “রাষ্ট্রপতিকে রাখা হয়েছে কেবল শেষ বিকল্প হিসেবে। যদি অন্য কোনো সমাধান না হয়, তখনই রাষ্ট্রপতির কথা বিবেচনা করতে হবে।”
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, “প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক প্রধান করার ফলে বিচারালয়কে রাজনৈতিক বিতর্কে জড়ানো হয়েছিল। তাই সর্বদলীয় কমিটির মাধ্যমে নতুন প্রধান উপদেষ্টা বাছাইয়ের প্রস্তাব করেছি।”
সালাহউদ্দিন আহমেদ অভিযোগ করেছেন, “বিএনপিকে সংস্কারবিরোধী হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা চলছে, অথচ বাস্তবে বিএনপিই সবচেয়ে বেশি সংস্কারের পক্ষে কাজ করছে। প্রায় ৯০ শতাংশ প্রস্তাবে আমরা একমত হয়েছি। যদি সবাই শতভাগ একমত হতে চায়, তাহলে আলোচনার কোনো মানে থাকে না।”
তিনি জানান, বিএনপি এমন প্রস্তাবও দিয়েছে, যাতে কেউ স্বৈরাচার হয়ে উঠতে না পারে। তার অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ সর্বাধিক ১০ বছর রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন তারা।
সংলাপে সভাপতিত্ব করেন ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। সঞ্চালনা করেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. আইয়ুব মিয়া প্রমুখ।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ আশাবাদ ব্যক্ত করেন, “যতটা এগোনোর কথা ছিল, ততটা না হলেও আমরা হতাশ নই। সবাই একসঙ্গে চেষ্টা করলে চলতি মাসেই জুলাই সনদ সই করার পর্যায়ে যেতে পারব।”
বাংলাধারা/এসআর