শহীদ ওসমান হাদীর মৃত্যু ঘিরে প্রশ্ন, অস্থির রাজনীতি ও ফ্যাসিবাদী আশঙ্কা
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২০, ২০২৫, ০২:২১ দুপুর
ছবি: বাংলাধারা
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান বিন হাদীর মৃত্যু বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে গভীর প্রশ্ন ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। একে ঘিরে দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিক্ষোভ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে, তা শুধু একটি হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া নয়- বরং এটি বৃহত্তর রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, হাদীর মৃত্যু কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। ভিন্নমত, রাষ্ট্রীয় জুলুমের বিরুদ্ধে অবস্থান এবং ন্যায়বিচারের দাবিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে এর আগেও একাধিক রাজনৈতিক কর্মী ও নাগরিক নানা ধরনের নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। হাদীর ক্ষেত্রেও একটি বিশ্বাসযোগ্য, স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্ত এখনো নিশ্চিত না হওয়ায় রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন বাড়ছে।
মানবাধিকার সংগঠন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, এই মৃত্যুর পেছনে প্রশাসনিক ব্যর্থতা কিংবা দমনমূলক রাজনৈতিক পরিবেশের প্রভাব উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অতীতে রাজনৈতিক সহিংসতা ও সন্দেহজনক মৃত্যুর ঘটনায় ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ বা ‘দুর্ঘটনা’ তত্ত্ব তুলে ধরা হলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেসব ব্যাখ্যা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। হাদীর মৃত্যুকেও অনেকেই সেই ধারার অংশ হিসেবে দেখছেন।
তবে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে- এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলা। বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ, ভাঙচুর ও উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড হাদীর রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মত বিশ্লেষকদের। কারণ, রাজনৈতিকভাবে হাদী পরিচিত ছিলেন শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ, যুক্তিনির্ভর আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে পরিবর্তনের পক্ষের একজন কর্মী হিসেবে।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করছেন, একটি হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে যদি নৈরাজ্য তৈরি হয়, তাহলে তা শেষ পর্যন্ত ন্যায়বিচারের পথকে সহজ করে না- বরং জটিল করে তোলে। ইতিহাসের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তারা বলছেন, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা প্রায়শই কর্তৃত্ববাদী বা ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থানের সুযোগ তৈরি করে।
আন্তর্জাতিক ও দেশীয় রাজনৈতিক গবেষণায় বহুল আলোচিত একটি তত্ত্ব হলো- “বিশৃঙ্খলা স্বৈরশাসনের জন্য সবচেয়ে কার্যকর পরিবেশ তৈরি করে।” মিসর, সিরিয়া কিংবা অন্যান্য দেশের উদাহরণ টেনে বিশ্লেষকরা বলছেন, গণআন্দোলনের পর সৃষ্ট অস্থিরতাকে ব্যবহার করেই সেখানে কঠোর শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়েছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও অতীত অভিজ্ঞতা ভিন্ন নয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়ে সামরিক ও বেসামরিক শাসনের নামে কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার উদাহরণ রয়েছে। সাম্প্রতিক অতীতে ‘স্থিতিশীলতা’ ও ‘উন্নয়ন’-এর বয়ানকে সামনে রেখে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নির্বাচন ব্যবস্থা ও বিচার বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের অভিযোগও রয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে, হাদীর মৃত্যুকে ঘিরে অরাজক পরিস্থিতি কার স্বার্থে কাজে লাগছে- সে প্রশ্ন উঠছে জোরালোভাবে। বিশ্লেষকদের মতে, জনগণের মধ্যে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হলে তারা অনেক সময় গণতান্ত্রিক অধিকার নয়, বরং ‘শক্ত হাতে শাসন’-কেই বিকল্প হিসেবে মেনে নিতে শুরু করে। এ প্রবণতা নতুন করে ফ্যাসিবাদী বাস্তবতা তৈরির আশঙ্কা বাড়ায়।
জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে তারা বলছেন, এই আন্দোলন দলীয় সীমার বাইরে গিয়ে গণতন্ত্র ও অধিকার প্রশ্নে মানুষের ঐক্যের প্রতিফলন ছিল। কিন্তু সেই ঐক্যকে ভাঙতে আন্দোলনকে সহিংস ও বিশৃঙ্খল হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা ইতিহাসে নতুন নয়। হাদীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অস্থিরতা সেই প্রচেষ্টাকে আরও জোরালো করতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শহীদ হাদীর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানাতে হলে তার নাম ব্যবহার করে অরাজকতা নয়, বরং তার মৃত্যুর নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করা, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নৈতিকতা বজায় রাখা এবং যেকোনো রূপের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা জরুরি।
বর্তমান পরিস্থিতিকে তারা বাংলাদেশের জন্য একটি সংবেদনশীল রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণ হিসেবে বর্ণনা করছেন। আবেগের পরিবর্তে প্রজ্ঞা ও দায়িত্বশীল রাজনৈতিক আচরণই এই সংকট মোকাবিলার একমাত্র পথ- এমনটাই মত সংশ্লিষ্টদের।
বাংলাধারা/এসআর
