টেন্ডার থেকে বদলি- কোটি টাকার বাণিজ্যে ‘আলাউদ্দিন সিন্ডিকেট’, বিআইডব্লিউটিসিতে মব নিয়ন্ত্রণ
প্রকাশিত: অক্টোবর ০৬, ২০২৫, ১১:৫২ দুপুর

ফাইল ছবি
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)- একসময় দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথে নির্ভরযোগ্য সেবা প্রদানের প্রতীক ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিষ্ঠানটি ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও ক্ষমতাসীন সিন্ডিকেটের খেলার মাঠে। এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের নেতা পরিচয়ে আলাউদ্দিন গংয়ের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা একটি শক্তিশালী চক্র আজ পুরো প্রতিষ্ঠানকে জিম্মি করে রেখেছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
অভিযোগকারীদের ভাষ্য, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে আলাউদ্দিন ও তার অনুসারীরা প্রকাশ্যে ভয়-ভীতি ও অরাজকতার পরিবেশ সৃষ্টি করতে শুরু করেন। শুধু তাই নয়, তিনি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টার বিরুদ্ধেও বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালাতে দ্বিধা করেননি। ধীরে ধীরে পুরো করপোরেশনে তিনি এমন এক ক্ষমতার বলয় তৈরি করেছেন, যেটিকে কর্মকর্তারা নাম দিয়েছেন-‘সিন্ডিকেট সাম্রাজ্য’।
এই সাম্রাজ্যের নেপথ্যে রয়েছেন প্রতিষ্ঠানের ভেতরের কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। অভিযোগে উল্লেখ আছে মহাব্যবস্থাপক (প্রঃ) জেসমিন আরা বেগম, চীফ অডিট অফিসার মো: রাশিদুর রহমান, চীফ পার্সোনেল ম্যানেজার মো: ফজলে রাব্বি এবং পরিচালক (প্রঃ) শেখ মুহা: নাসিমের নাম। তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা ছাড়া টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগ-বদলি থেকে শুরু করে কোটি কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম চালানো সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন প্রতিষ্ঠানটির ভেতরের অনেকেই।
সবচেয়ে ভয়ংকর চিত্র ফুটে উঠেছে বদলি বাণিজ্যের ঘটনায়। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জাহাজী বদলির নামে একজনের কাছ থেকে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ আদায় করা হচ্ছে। এমনকি আগামী ২০২৬ সাল পর্যন্ত বদলির পরিকল্পনাও আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। এভাবে কোটি টাকার অবৈধ অর্থ হাতবদল হয়েছে বলে অভিযোগ। একটি ঘটনায় প্রায় ৭০ লাখ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ ইতোমধ্যেই দুদকের অনুসন্ধানে রয়েছে। অর্থাৎ দুর্নীতি এখন কেবল গুঞ্জন নয়, তা তদন্তের আওতায় চলে এসেছে।
কেবল আর্থিক অনিয়মই নয়, সিন্ডিকেট সরাসরি ভয় দেখাতেও কুণ্ঠিত হচ্ছে না। ৩০ সেপ্টেম্বর চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে প্রবেশ করে আলাউদ্দিন ও তার অনুসারীরা প্রকাশ্যে অসৌজন্যমূলক আচরণ এবং হুমকি প্রদর্শন করেন। ঘটনাস্থলের ছবি ও ভিডিও প্রমাণ হিসেবে সংরক্ষিত রয়েছে। এতে স্পষ্ট হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের ভেতরে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে এবং কর্মকর্তারা এখন প্রতিদিনই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
আলাউদ্দিন গং বিএনপি’র নাম ভাঙিয়ে কর্মকর্তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ তার কাছে কোনো বৈধ ইউনিয়নের কাগজপত্রই নেই। বৈধতা ছাড়াই কেবল রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়কে ঢাল বানিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠানের ভেতরে দাপট দেখিয়ে যাচ্ছেন। প্রশ্ন উঠছে- এমন পরিস্থিতিতে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কেন নীরব দর্শকের ভূমিকায়?
ভুক্তভোগী কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, অবিলম্বে আলাউদ্দিনের বৈধতা যাচাই, চেয়ারম্যানের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণে জড়িতদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ, পরিচালক শেখ মুহা: নাসিমের পদোন্নতি ও নিরীক্ষা আপত্তি তদন্ত এবং আলাউদ্দিনের সম্পদের উৎস খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তাদের মতে, এ ধরনের পদক্ষেপ না নিলে ‘আলাউদ্দিন সিন্ডিকেটের মব শাসন’ আরও ভয়ংকর আকার ধারণ করবে।
বিআইডব্লিউটিসি রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন ব্যবস্থা যেখানে লাখো মানুষের যাতায়াত ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড নির্ভরশীল, সেখানে এমন দুর্নীতি ও অরাজকতা গোটা ব্যবস্থাকেই হুমকির মুখে ফেলেছে। কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য চলতে থাকলে কেবল প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, বরং দেশের নৌপরিবহন ব্যবস্থায়ও স্থায়ী সংকট তৈরি হবে।
অভিযোগকারীরা তাই সতর্ক করেছেন- অবিলম্বে ব্যবস্থা না নিলে বিআইডব্লিউটিসি পরিণত হবে এক ভয়ংকর উদাহরণে, যেখানে দুর্নীতি, রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও মব শাসনের কারণে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাধারা/এসআর