প্রসিকিউটর দিয়ে তদন্ত: মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সিদ্ধান্ত ঘিরে আইনি ও নৈতিক প্রশ্ন
প্রকাশিত: মে ২১, ২০২৫, ১০:০৬ দুপুর

ফাইল ছবি
প্রজ্ঞাপন নেই, নেই আইনগত ভিত্তিও - তবু তদন্তে যুক্ত হচ্ছেন প্রসিকিউটররা
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক এক সিদ্ধান্ত ঘিরে শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক। আইনগত এখতিয়ার ও প্রজ্ঞাপন ছাড়াই অধিদপ্তরের প্রসিকিউটর ও সহকারী প্রসিকিউটরদের দিয়ে মাদক মামলার তদন্ত করানো হচ্ছে। অথচ তারা তদন্ত কর্মকর্তা নন, এমনকি তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য সংক্রান্ত সরকারি নথিপত্রেও তদন্তের কোনো উল্লেখ নেই।
ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের অফিস আদেশ অনুযায়ী, ২০ এপ্রিল ২০২৫ সালের এক সমন্বয় সভায় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. হাসান মারুফ সিদ্ধান্ত দেন, অধিদপ্তরের অধীন প্রতিটি প্রসিকিউটর ও সহকারী প্রসিকিউটর অন্তত একটি করে মাদক মামলার তদন্ত সম্পন্ন করবেন। এরই ভিত্তিতে তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে বিভিন্ন জেলা ও মেট্রো অফিসে।
কিন্তু আইন বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত প্রশ্নবিদ্ধ এবং আইনি কাঠামোর বাইরে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮-এর ৬৪ ধারা অনুযায়ী, কেবল উপপরিদর্শক বা তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাই অপারেশনাল দায়িত্ব পালন করতে পারেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২০১৯ সালের একটি প্রজ্ঞাপন অনুসারে, তদন্তে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের তালিকায় প্রসিকিউটরের নাম নেই। ফলে সরকারিভাবে প্রকাশিত কোনো প্রজ্ঞাপন ছাড়া ডিজির এ ধরনের সিদ্ধান্তের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর মো. ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, “প্রসিকিউটরের দায়িত্ব বিচার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করা, তদন্ত নয়। তারা যদি তদন্ত করেন, তাহলে সেটা পক্ষপাতহীন তদন্ত হবে না। আইনগত প্রশিক্ষণ না থাকায় ভুল হওয়াও স্বাভাবিক।”
অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কেবল প্রজ্ঞাপন দিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে আসা উচিত ছিল। অথচ একটি সমন্বয় সভার সিদ্ধান্তে, কোনো লিখিত সরকারি আদেশ বা আইনি ভিত্তি ছাড়াই তদন্তের দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রসিকিউটরদের।
ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক এ কে এম শওকত ইসলাম বলেন, “চিঠিটি মূলত ডিজির আদেশের ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে। আমাদের এখানে কিছু করার ছিল না। ডিজি ভবিষ্যতের প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে বিষয়টি নিয়মতান্ত্রিকভাবে হওয়া উচিত ছিল।”
অন্যদিকে প্রসিকিউটরদের মধ্যে কেউ কেউ ডিজির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও, অনেকেই দ্বিধায় রয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রসিকিউটর ফৌজিয়া মুবাশ্বের নীলিম বলেন, “আমরা যদিও আগে তদন্ত করিনি, তবে অভিযানে অংশ নিয়েছি। কিছু গাইডলাইন অনুসরণ করলেই তদন্ত করা সম্ভব।”
তবে এই বক্তব্য আইনবিদদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তদন্তের নিরপেক্ষতা এবং ফৌজদারি বিচারের সার্বিক প্রক্রিয়ায় এর প্রভাব নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা। কারণ, তদন্ত ও প্রসিকিউশন—এই দুইটি কাজ আলাদা ও স্বাধীন হওয়া জরুরি, যাতে বিচারপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বজায় থাকে।
২০১৯ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে প্রসিকিউশন ইউনিট চালু হয়। তখন থেকে তাদের মূল দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয় আদালতে মামলা পরিচালনা, জামিন বিরোধিতা, সাক্ষী হাজির ও রায় পরবর্তী আপিল কার্যক্রমে সহযোগিতা করা। বর্তমানে দেশে ৬৮ জন প্রসিকিউটর ও ১০৪টি সহকারী প্রসিকিউটরের পদ রয়েছে, যদিও সবগুলো পদ পূর্ণ হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনি কাঠামো মেনে না চললে ভবিষ্যতে এসব মামলার তদন্ত নিয়ে আদালতে প্রশ্ন উঠতে পারে। এমনকি অভিযুক্তদের মুক্তি পাওয়ার ক্ষেত্রেও এটি প্রভাব ফেলতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চেয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ডিজি মো. হাসান মারুফের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। তাঁর অফিসে সরাসরি গিয়েও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মোস্তাক আহমেদের মাধ্যমে লিখিতভাবে জানানো হলেও, এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো উত্তর আসেনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে যথাযথ প্রশাসনিক ও আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ না করলে তা শুধু প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে না, বরং ন্যায়বিচারের পথকেও প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
বাংলাধারা/এসআর