জুলাই জাতীয় সনদ আজই চূড়ান্ত করতে চায় কমিশন
প্রকাশিত: জুলাই ৩১, ২০২৫, ১০:৪৮ দুপুর

ছবি: সংগৃহিত
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আজ বৃহস্পতিবার প্রস্তাবিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর খসড়া চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে। কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দীর্ঘ এক মাসের সংলাপ শেষে প্রাথমিকভাবে প্রস্তাবিত ১৬৬টি বিষয়ের মধ্যে শতাধিক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য গড়ে উঠেছে। তবে এখনো সংরক্ষিত নারী আসন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও নিয়োগ, সংবিধান সংশোধনসহ আটটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয় সংলাপের দ্বিতীয় ধাপের ২২তম দিনের আলোচনা। এতে অংশ নেয় ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি। আলোচনা পরিচালনা করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ এবং সঞ্চালনা করেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
সংলাপে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে জাতীয় সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব প্রসঙ্গ। কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, বর্তমানে সংরক্ষিত ৫০টি নারী আসন বহাল রেখে আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোকে ন্যূনতম ৫ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়ন দিতে হবে। এ হার পরবর্তী নির্বাচনে ১০ শতাংশে উন্নীত করার প্রত্যাশা জানানো হয়েছে। ধাপে ধাপে তা ৩৩ শতাংশে পৌঁছানোর লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। বিএনপি প্রস্তাব করেছে, ২০২৬ সালের নির্বাচনে ৫ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হবে, যা পরবর্তী নির্বাচনে বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করা হবে। জামায়াতে ইসলামী নারী প্রতিনিধিত্বে সরাসরি ভোট নয়, বরং সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির পক্ষপাতী। অন্যদিকে এনসিপি, সিপিবি, বাসদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফোরামসহ কয়েকটি দল সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নারী নির্বাচনের পক্ষে মত দেয়। নানা মতপার্থক্য সত্ত্বেও আলোচনা শেষে ৫ শতাংশ নারী প্রার্থিতা নিয়ে অধিকাংশ দলের সমর্থনে একটি সমঝোতায় পৌঁছায় কমিশন।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও নিয়োগসংক্রান্ত বিষয়ে কমিশন একটি সুস্পষ্ট প্রস্তাব পেশ করেছে। বর্তমানে সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি কেবল প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা নিয়োগে স্বতন্ত্র সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কমিশন প্রস্তাব করেছে, রাষ্ট্রপতির হাতে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের ক্ষমতা থাকা উচিত। এসব পদের মধ্যে রয়েছে তিন বাহিনীর প্রধান, অ্যাটর্নি জেনারেল, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, প্রেস কাউন্সিল, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনসহ অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান ও মহাপরিচালকের পদ।
এদিকে জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি না থাকলে তা অর্থহীন হবে বলে মন্তব্য করেছে জামায়াতে ইসলাম এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আইনি ভিত্তি ছাড়া এই সনদ বাস্তবায়নযোগ্য নয় এবং জনগণের কাছেও এর কোনো গুরুত্ব থাকবে না। একই দাবি জানিয়ে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে আইনি ভিত্তিসহ ঘোষণা না এলে এনসিপি এটি প্রত্যাখ্যান করবে এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
আখতার হোসেন বলেন, ‘জুলাই সনদ’ এবং ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ এক নয়। সনদটি রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কারসংক্রান্ত, আর ঘোষণাপত্রটি রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ব্যাখ্যা করে। তিনি জানান, এনসিপি দুই বছরের জন্য এই সনদ কার্যকর করার প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের দাবি, এটি সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেতেই হবে, না হলে পরবর্তী সরকার স্বীকার করবে এমন আশ্বাসের কোনো ভিত্তি থাকবে না।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, সংলাপের একপর্যায়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আলোচনার অগ্রগতি ও মতভেদগুলো অবহিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে ১৪টি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হয়েছে। বাকি বিষয়ের সংশোধনী দলগুলোর পক্ষ থেকে লিখিতভাবে জমা দেওয়া হয়েছে এবং আজ চূড়ান্ত খসড়া অনুমোদনের জন্য কমিশন তা পর্যালোচনা করবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার দায়িত্ব কমিশনকেই দেওয়া হয়েছে বলে জানান আলী রীয়াজ। তিনি আশা প্রকাশ করেন, আজকের মধ্যেই চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে।
বিশ্লেষকদের মতে, আজকের দিনটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কারে একটি টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে। তবে কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়নে আইনগত নিশ্চয়তা না এলে এটি কেবল একটি প্রতীকী দলিলে পরিণত হবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাধারা/এসআর