১৫ বছরে ব্যাংক লুটে পৌনে ২ লাখ কোটি টাকা উধাও: বাংলাদেশ ব্যাংকের বিস্ফোরক প্রতিবেদন
প্রকাশিত: মে ২১, ২০২৫, ১০:১২ রাত

ফাইল ছবি
দেশের ব্যাংকিং খাতে যেন চলছে এক দীর্ঘকালীন ‘অঘোষিত লুটপাটের উৎসব’। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে অন্তত ২০টি ব্যাংক থেকে প্রায় ১ লাখ ৭১ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা মূলধন লোপাট হয়েছে- যা স্পষ্টতই আর্থিক খাতকে করেছে চরম ঝুঁকিপূর্ণ ও অবিশ্বাস্যরকম দুর্বল।
২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) এই বিশাল অঙ্কের ঘাটতির চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে মূলধন ঘাটতি বেড়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা- এটা শুধু উদ্বেগজনকই নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০টি ব্যাংকের মধ্যে যেসব ব্যাংকে বড় অঙ্কের মূলধন ঘাটতি দেখা গেছে, সেগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক- ৫২ হাজার ৮৯১ কোটি টাকা ঘাটতি। এরপর রয়েছে:
- বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক: ১৮,১৯৯ কোটি
- ইউনিয়ন ব্যাংক: ১৫,৬৯০ কোটি
- ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক: ১৩,৯৯১ কোটি
- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ: ১২,৮৮৫ কোটি
- সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক: ১১,৭০৯ কোটি
- আইএফআইসি ব্যাংক: ৯,০২৯ কোটি
- ন্যাশনাল ব্যাংক: ৭,৭৯৯ কোটি
- রূপালী ব্যাংক: ৫,১৯২ কোটি
- পদ্মা ব্যাংক: ৪,৯৮৫ কোটি
এছাড়া বেসিক, অগ্রণী, গ্লোবাল ইসলামী, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন, আইসিবি ইসলামিক, স্ট্যান্ডার্ড, এবি, আল আরাফাহ এবং হাবিব ব্যাংকের বিরাট অঙ্কের ঘাটতির চিত্রও রয়েছে।
মূলধন ও ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের অনুপাত (সিআরএআর) ডিসেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩.০৮ শতাংশ। অথচ আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী প্রতিটি ব্যাংকের এই অনুপাত থাকা উচিত ১০ শতাংশের ওপরে। সেপ্টেম্বরে এই অনুপাত ছিল ৬.৮৬ শতাংশ, সেখান থেকে আরও অর্ধেকে নেমে আসা মানে- ব্যাংক খাতের ভিতরেই প্রবল ভূমিকম্প।
এ অবস্থায়, ব্যাংকগুলো বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে পারছে না, বরং বিদেশি ব্যাংকের কাছে ক্রেডিট রেটিং হারাচ্ছে, ঝুঁকিতে পড়ছে এলসি খোলা, আমদানি ব্যয়ও বাড়ছে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি। একই সময়ে ঋণ অবলোপন (যা আদায়ের সম্ভাবনা প্রায় নেই বলেই বিবেচিত) বেড়েছে ৯ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা, দাঁড়িয়েছে ৮১ হাজার ৫৭৮ কোটিতে।
অন্যদিকে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ ঢাকতে ৩ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃতফসিলও করেছে। অর্থাৎ, সমস্যা শুধু খেলাপি ঋণ নয়- বরং তা ঢাকা দিতেই চলছে হিসাবের কৌশল।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, ‘‘উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে প্রভিশন রাখতে না পারায় ব্যাংকগুলো এখন মূলধন ঘাটতিতে। কিছু ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে লোকসানে ছিল, তবে আগের সরকারে ঘনিষ্ঠ থাকার কারণে এগুলো গোপন ছিল। এখন তা ফাঁস হচ্ছে।’’
তিনি বলেন, ‘‘মূলধন ঘাটতির অর্থ, ব্যাংকগুলো নতুন করে ঋণ দিতেও অক্ষম। এতে শুধু তাদের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে না, বরং তারা বিদেশি ব্যাংকের সঙ্গেও লেনদেনে পিছিয়ে পড়ছে।’’
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ এই অবস্থা সম্পর্কে বলেন, ‘‘গত ১৫ বছরে দেশে যে আর্থিক নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছিল, তা অকল্পনীয়। প্রায় ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে অর্ধেকের বেশি এখন খারাপ অবস্থায়। কয়েকটি ব্যাংক এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, তারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছে না। নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না।’’
ব্যাংকিং খাতকে ঘিরে চলমান এই লুটপাট, মূলধন সংকট, খেলাপি ঋণ এবং তদারকিহীনতা প্রমাণ করছে-দেশের আর্থিক খাত এখন চরম বিপদে। এই অবস্থায় যদি কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, ঋণ আদায় কার্যক্রম জোরদার না করা হয় এবং ব্যাংকিং নীতিমালায় স্বচ্ছতা ফিরিয়ে না আনা যায়, তবে এই খাতের ভরাডুবি শুধু দেশের অর্থনীতিকেই নয়, সাধারণ মানুষকেও বিপন্ন করে তুলবে।
বাংলাধারা/এসআর