বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তিতে আগ্রহী জাপান
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২৫, ১০:৩১ দুপুর

ছবি: সংগৃহিত
বাংলাদেশের সঙ্গে বিশেষায়িত প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে যাচ্ছে জাপান। চলতি বছরের মধ্যেই চুক্তির প্রাথমিক খসড়া সই হতে পারে বলে কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে। চুক্তি কার্যকর হলে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও যৌথ গবেষণার মাধ্যমে দুই দেশের সহযোগিতা নতুন মাত্রা পাবে।
ইউনূসের টোকিও সফরের পর অগ্রগতি
গত মে মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস টোকিও সফর করেন। সেখানে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সঙ্গে বৈঠকে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়। ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বৈঠকের ধারাবাহিকতায় উভয় দেশ নীতিগতভাবে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ও সমরাস্ত্র বিনিময়ের বিষয়ে সম্মত হয়েছে।
এর আগে ২০২৩ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ ও জাপান প্রতিরক্ষা সহযোগিতার একটি সম্মতিপত্রে সই করেছিল, যার ভিত্তিতেই বিস্তারিত চুক্তির প্রস্তুতি এগোচ্ছে।
চুক্তির প্রস্তাবিত কাঠামো
জাপানের প্রতিরক্ষা নীতি অনুযায়ী বাংলাদেশ-জাপান চুক্তি তিনটি মূল বিষয়ে গড়ে উঠছে-
প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম হস্তান্তর: নৌ টহলযান, যোগাযোগব্যবস্থা, নজরদারি প্রযুক্তি ও অপ্রাণঘাতী সরঞ্জাম।
যৌথ গবেষণা: সাইবার নিরাপত্তা, স্যাটেলাইট প্রযুক্তি, উপকূলীয় নজরদারি ইত্যাদি ক্ষেত্রে সমন্বয়।
কঠোর নিয়ন্ত্রণ: সরবরাহকৃত অস্ত্র তৃতীয় কোনো দেশে বিক্রি করা যাবে না এবং ব্যবহার নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব ধারা বাংলাদেশকে সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও সাইবার প্রতিরক্ষায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ দেবে।
চীন-জাপান প্রতিযোগিতা ও বাংলাদেশের অবস্থান
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ইতিবাচক হলেও এর ভূরাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে চীনের কাছ থেকে সমরাস্ত্র কিনে আসছে। ফলে জাপানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা চীনকে কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলতে পারে। তাই বড় শক্তিগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে এগোতে হবে ঢাকাকে।
জাপানের নতুন নীতি ও ব্যবসায়িক আগ্রহ
জাপান সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানির আইন শিথিল করার পর এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাজার খুঁজছে। ২০২২ সালে ঢাকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সম্ভাবনাময়। সে সময় মিৎসুবিশি ইলেকট্রনিকসের প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করে বিমানবাহিনীর রাডার ও আকাশ প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা করেছিল।
অর্থায়ন ও বাস্তবায়ন
কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, প্রয়োজনে আর্থিক সহায়তার ভিত্তিতেও বাংলাদেশকে অস্ত্র বিক্রির প্রস্তাব বিবেচনা করছে জাপান। শেখ হাসিনার টোকিও সফরের প্রস্তুতিকালে বিষয়টি আলোচনায় এলেও সফর স্থগিত হয়ে যায়।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ. ন. ম. মুনীরুজ্জামান মনে করেন, “এই চুক্তি বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। শুধু অস্ত্র নয়, প্রযুক্তিগত সহায়তাও পাওয়া যাবে, আর এতে কোনো বাধ্যতামূলক রাজনৈতিক শর্ত নেই।”
জাপানের অন্যান্য চুক্তি
২০১৩ সালে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করে জাপান। এরপর ভারত, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন ও মঙ্গোলিয়াসহ এখন পর্যন্ত ১২টি দেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি বিনিময়ের চুক্তি করেছে তারা।
অন্যদিকে, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ ১১টি দেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষাবিষয়ক ২০টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করেছে। সর্বশেষ এ বছরের আগস্টে মালয়েশিয়ার সঙ্গে নতুন একটি এমওইউ হয়।
বাংলাদেশের লাভ ও চ্যালেঞ্জ
জাপানের সঙ্গে সম্ভাব্য প্রতিরক্ষা চুক্তি বাংলাদেশকে আধুনিক প্রযুক্তি, সরঞ্জাম ও সাইবার নিরাপত্তায় এগিয়ে নেবে। একই সঙ্গে এটি আঞ্চলিক কূটনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। তবে বড় শক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভারসাম্য রক্ষা করাই হবে বাংলাদেশের প্রধান চ্যালেঞ্জ।
সব মিলিয়ে, কূটনীতিক ও বিশ্লেষকদের মতে, এ উদ্যোগ বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা কূটনীতিতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
বাংলাধারা/এসআর