ঢাকা, সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫, ২৩ আষাঢ় ১৪৩২

ফ্যাসিবাদের কবলে চাঁদপুর রেড ক্রিসেন্ট, মানবিকতা আজ রাজনীতির হাতিয়ার

নিজস্ব প্রতিবেদক

 প্রকাশিত: জুলাই ০৩, ২০২৫, ১১:২২ রাত  

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, চাঁদপুর ইউনিট কার্যালয় ছবি: বাংলাধারা।

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, চাঁদপুর ইউনিট, আজও আওয়ামী ফ্যাসিবাদের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি। বহু প্রতিশ্রুতি আর চটকদার ঘোষণার পরও, অদৃশ্য রাজনৈতিক শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় একটি প্রভাবশালী চক্র এখনো ইউনিট অফিস কুক্ষিগত করে রেখেছে। ফলে চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে সংগঠনটির স্বাভাবিক কার্যক্রম, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রকৃত স্বেচ্ছাসেবক এবং চাঁদপুরের সাধারণ মানুষ, যারা দুর্যোগ ও বিপদের সময়ে এই মানবিক সংগঠনের ওপর নির্ভর করেন।

বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের সময় থেকেই চাঁদপুর রেড ক্রিসেন্ট ইউনিটে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। সেই প্রভাব এখনো তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, জাতীয় সদর দপ্তর কিংবা বিদেশ থেকে প্রাপ্ত অর্থ বা ত্রাণসামগ্রী প্রকৃত দুস্থদের কাছে না পৌঁছে, কেবল ফটোসেশনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে বিতরণ। আসলে তা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক প্রচার ও নিজেদের “মানবিক নেতা” প্রমাণের হাতিয়ার। অথচ এই ত্রাণসামগ্রী বা অর্থের মূল উদ্দেশ্য ছিলো বিপদাপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানো।

আরও উদ্বেগের বিষয়, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, সহ-শিক্ষা কার্যক্রম কিংবা প্রজেক্ট বাস্তবায়নের নামে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডের পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠ মহলের প্রত্যক্ষ মদদ।

বিশেষ করে চাঁদপুর যুব রেড ক্রিসেন্ট, একসময় যেটি সারা দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করেছিলো স্বেচ্ছাসেবী মনোভাব, শৃঙ্খলা এবং মানবিক সেবার জন্য, সেই সংগঠনটি আজ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের একাংশের ব্যক্তিগত আখের গোছানোর যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। ৫ আগস্টের ঘটনার পর, ছাত্রলীগের যে নেতাকর্মীরা বিভিন্ন অপকর্মে যুক্ত ছিলেন, তারা নিজেদের কর্মকাণ্ড আড়াল করতে যুব রেড ক্রিসেন্টের ব্যানার ব্যবহার করছেন। সাধারণ মানুষের কাছে নিজেদের বড় মাপের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে উপস্থাপন করছেন, অথচ মূলত তারা ক্ষমতা, প্রভাব ও আর্থিক সুবিধা পেতে এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছেন।

এই চক্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন প্রকৃত স্বেচ্ছাসেবকরা। কেউ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, কেউ আবার পরিবার ও সমাজের ভয়ে আত্মগোপনে আছেন। কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই বহিষ্কার করা হচ্ছে দক্ষ ও অভিজ্ঞ স্বেচ্ছাসেবকদের। অফিসে না আসতে নানাভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া স্বেচ্ছাসেবকরা এখন এই সংগঠনে যেতে ভয় পাচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে আছেন মেয়ে স্বেচ্ছাসেবকরা। তাদের নিরাপত্তাহীনতা প্রকট হয়ে উঠেছে।

বিশ্লেষক ও স্থানীয়দের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের ঘনিষ্ঠ একাধিক ব্যক্তি এই অবৈধ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে জড়িত। তাদের মধ্যে রয়েছেন মাগুরা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও রেড ক্রিসেন্ট জাতীয় সদর দপ্তরের সাবেক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আব্দুল ওয়াহাবের আত্মীয় এবং সাবেক ছাত্রলীগ নেতা,  বর্তমানে রেড ক্রিসেন্ট চাঁদপুর ইউনিউ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ফাহাদ আল নূর সাজিদ। আরও রয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় আইন বিষয়ক সম্পাদক নজীবুল্লাহ হারুর আত্মীয় কলেজ ছাত্রলীগ নেতা ওমর বীন ইউসুফ চৌধুরী, সুজিত রায় নন্দীর আস্থাভাজন আবুল বাসার নোমান, ছাত্রলীগ নেতা কাঁকন গাজীর সহযোগী জিয়াউল হাসান ফাহিম, ছাত্রলীগ কর্মী প্রান্ত কর্মকার ও তাহমিনা আক্তারসহ অনেকেই।

ছাত্রলীগ নেতা ফাহিম একবার ডিবি পুলিশের হাতে আটক হলেও অদৃশ্য কোনো রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় ছাড়া পেয়ে আবারও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

চাঁদপুর রেড ক্রিসেন্টের সাবেক ও বর্তমান অনেক স্বেচ্ছাসেবক আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছেন, “এভাবে চলতে থাকলে চাঁদপুরের এই সুনামধন্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাবে। ত্রাণ, সহায়তা ও মানবিক সেবা- সবকিছুই রাজনীতির ছদ্মাবরণে ব্যক্তি-স্বার্থের হাতে চলে যাচ্ছে।”

চাঁদপুরের সাধারণ মানুষ এবং প্রকৃত স্বেচ্ছাসেবীরা এখন চাইছেন, অবিলম্বে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ভিত্তিতে চাঁদপুর রেড ক্রিসেন্টের পুনর্গঠন। নাহলে মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলতে চলেছে একসময়কার গৌরবের এই মানবিক প্রতিষ্ঠান।

 

বাংলাধারা/এসআর