বাংলাদেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বিশ্বে দ্বিতীয়: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে ভয়াবহ প্রভাব
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৫, ০২:৩৪ দুপুর

ছবি: সংগৃহিত
বাংলাদেশ ক্রমেই পরিণত হচ্ছে এক ‘তাপ-হটস্পট’-এ। বিশ্ব ব্যাংকের একটি নতুন প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার বিশ্বে দ্বিতীয়, যা শুধু পরিবেশ নয়, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতেও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে তাপের প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সৈয়দুর রহমান। প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিশ্ব ব্যাংকের সিনিয়র অপারেশনস অফিসার ইফফাত মাহমুদ এবং সিনিয়র স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ওয়ামেক এ. রাজা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে মানুষের অনুভূত তাপমাত্রা বেড়েছে আরও বেশি, ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিশেষত রাজধানী ঢাকায় তাপমাত্রা বেড়েছে ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক বেশি।
বিশ্ব ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক আবহাওয়া সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণ ৯টি বছর। অপরিকল্পিত নগরায়ন, বৃক্ষনিধন ও কংক্রিট-নির্ভর উন্নয়ন এই তাপ বৃদ্ধির মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
স্বাস্থ্যঝুঁকি ও রোগের প্রবণতা বৃদ্ধি
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক রোগের প্রকোপও বেড়েছে।
শ্বাসকষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদি কাশিতে শীতকালে আক্রান্ত ৩.৩%, গ্রীষ্মে বেড়ে ৬%। ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় ঝুঁকি ২২.৭% বাড়ে।
তাপজনিত ক্লান্তিতে কর্মক্ষম মানুষ ও প্রবীণরা বেশি ভোগেন। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় ঝুঁকি ২৬.৫% বাড়ে।
ডায়রিয়া: শীতে আক্রান্ত ১.৮%, গ্রীষ্মে ৪.৪%। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নারী ও পাঁচ বছরের নিচের শিশু।
মানসিক স্বাস্থ্য: গ্রীষ্মে বিষণ্নতা ২০% এবং উদ্বেগ ১০% পর্যন্ত বাড়ে। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় বিষণ্নতা ২৩.৮% এবং উদ্বেগ ৩৭.১% পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
অর্থনৈতিক ক্ষতি ভয়াবহ
তীব্র গরম কেবল স্বাস্থ্য নয়, অর্থনীতিতেও বড় ক্ষতি করেছে। ২০২৪ সালে তাপজনিত কারণে ২১ হাজার কোটি টাকার কর্মদিবস নষ্ট হয়েছে। এর ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ১.৩৩ থেকে ১.৭৮ বিলিয়ন ডলার, যা জিডিপির ০.৩ থেকে ০.৪ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ২০৩০ সালের মধ্যে এই ক্ষতি বেড়ে দাঁড়াতে পারে জিডিপির ৪.৯ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ
প্রতিবেদনে পাঁচটি সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে:
১. জাতীয় প্রস্তুতি জোরদার করা।
২. স্বাস্থ্যখাতকে তাপ-সম্পর্কিত জরুরি সেবা নিশ্চিত করা।
৩. প্রতিরোধমূলক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং ছায়াযুক্ত, ঠান্ডা কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা।
৪. শক্তিশালী আবহাওয়া তথ্য ব্যবস্থাপনা ও সতর্কতা প্রদান।
৫. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও অর্থায়ন বাড়ানো।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, তাপপ্রবাহ এখন বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকট। তবে বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য এটি এক অস্তিত্বের প্রশ্ন। নীতি নির্ধারণ, নগর পরিকল্পনা, স্বাস্থ্যসেবা ও সবুজায়নে ‘তাপ-সচেতনতা’ আনতে না পারলে ক্ষতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
বাংলাধারা/এসআর