ডব্লিউএইচওর বৈশ্বিক প্রতিবেদনে শঙ্কার চিত্র
বিশ্বে উচ্চ রক্তচাপে বছরে কোটি প্রাণহানি
প্রকাশিত: অক্টোবর ০৪, ২০২৫, ১১:০৬ দুপুর

ছবি: সংগৃহিত
বিশ্বে বর্তমানে প্রায় ১৪০ কোটি মানুষ উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যায় ভুগছে। তাদের মধ্যে প্রতি পাঁচজনের মাত্র একজন নিয়মিত চিকিৎসা ও ওষুধ সেবনের মাধ্যমে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছেন। অথচ চিকিৎসা ও প্রতিরোধের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও প্রতিবছর এক কোটিরও বেশি মানুষ উচ্চ রক্তচাপজনিত জটিলতায় মারা যাচ্ছেন। জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ পরিষদের সময় গত ২৩ সেপ্টেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিজ ও রিসলভ টু সেভ লাইভস-এর যৌথ আয়োজনে প্রকাশিত ডব্লিউএইচওর দ্বিতীয় বৈশ্বিক উচ্চ রক্তচাপ প্রতিবেদন এ তথ্য জানায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের চিকিৎসায় প্রায় ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে, যা দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ। নিয়ন্ত্রণহীন উচ্চ রক্তচাপ হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ এবং ডিমেনশিয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, এটি প্রতিরোধযোগ্য ও চিকিৎসাযোগ্য রোগ হলেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে লাখ লাখ মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করবে এবং অর্থনীতিও বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম ঘেব্রেয়েসাস বলেছেন, উচ্চ রক্তচাপের কারণে প্রতি ঘণ্টায় এক হাজারের বেশি মানুষ স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। এর বেশিরভাগ মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য। রাজনৈতিক অঙ্গীকার, বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যসেবায় উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ অন্তর্ভুক্ত করা গেলে লাখো মানুষের জীবন রক্ষা করা সম্ভব। একই অনুষ্ঠানে ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিজ পাবলিক হেলথ প্রোগ্রামের প্রধান ড. কেলি হেনিং বলেন, অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ প্রতি বছর এক কোটিরও বেশি মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ও প্রাথমিক চিকিৎসার সঙ্গে এ যত্ন যুক্ত করার মাধ্যমে অগ্রগতি শুরু হলেও বহু নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশ এখনো পিছিয়ে আছে। তাঁর মতে, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং চিকিৎসার সুযোগ সম্প্রসারণ ছাড়া এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়।
বিশ্বের ১৯৫টি দেশ ও অঞ্চলের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর মধ্যে ৯৯টি দেশে জাতীয় পর্যায়ে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের হার ২০ শতাংশের নিচে। আক্রান্তদের বড় অংশই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে বাস করেন, যেখানে স্বাস্থ্যব্যবস্থা দুর্বল এবং চিকিৎসাসেবা সীমিত। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, অ্যালকোহল ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা, লবণ ও ট্রান্স ফ্যাটের অতিরিক্ত গ্রহণ, দুর্বল স্বাস্থ্যনীতি, মানসম্মত চিকিৎসা প্রোটোকল ও প্রশিক্ষিত চিকিৎসক দলের অভাব এবং ব্যয়বহুল ওষুধ—সব মিলিয়ে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ওষুধের প্রাপ্যতাকেও প্রতিবেদনে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখানো হয়েছে। বর্তমানে রক্তচাপের ওষুধ জনস্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য হলেও নিম্ন আয়ের বহু দেশে এর সরবরাহ সীমিত। ২৫টি নিম্ন আয়ের দেশের মধ্যে মাত্র সাতটিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত সব ওষুধ পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ব্যবধান দূর করা গেলে কোটি কোটি মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হবে এবং প্রতিবছর বিপুল অর্থ সাশ্রয় করা যাবে।
সব বাধা সত্ত্বেও কিছু দেশ আশার আলো দেখাচ্ছে। বাংলাদেশ ২০১৯ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে কিছু অঞ্চলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের হার ১৫ শতাংশ থেকে ৫৬ শতাংশে উন্নীত করেছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় স্ক্রিনিং ও ফলো-আপ কার্যক্রম জোরদার করা এবং অপরিহার্য স্বাস্থ্যসেবা প্যাকেজে উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসা যুক্ত করায় এ অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। একইভাবে দক্ষিণ কোরিয়া ওষুধের খরচ কমানো ও চিকিৎসা ফি সীমিত করার মতো পদক্ষেপ নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণকে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাদের মতে, কার্যকর নীতি, সুলভ ওষুধ এবং শক্তিশালী স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে লাখ লাখ অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে। একইসঙ্গে নিয়ন্ত্রণহীন উচ্চ রক্তচাপের কারণে সৃষ্ট ভয়াবহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতিও অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
বাংলাধারা/এসআর